April 18, 2024, 11:07 pm

বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবেই রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়

অনলাইন ডেস্ক।।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবেই রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরে এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন শুরু থেকেই। এর আগে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চায় মুসলিম লীগ। বঙ্গবন্ধু এতে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার বিরাট ষড়যন্ত্র মনে করেন।
এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তন মুসলীম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।’
১৯৫১ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বঙ্গবন্ধু তখন জেলের হাসপাতালে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৬ পৃষ্ঠায় এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ , কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রনেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশেরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ, জানে, আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগেই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল্। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে।”
বঙ্গবন্ধু আরো লিখেন, ‘খবর পেয়েছি আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস। আরো দুএকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বললাম, আমিও আমার মুক্তি দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করবো। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে।’
সংগ্রাম পরিষদ গঠন হলে শেখ মুজিবসহ নেতা-কর্মীরা কাজে নেমে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিনদিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখমও হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই, আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম।’
ড. মোহাম্মদ হাসান খান এ নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনের সময় প্রতিদিনের বিষয় ছিল পুলিশের হামলা। আন্দোলন দানা বাঁধলে ১১ মার্চ শেখ মুজিবসহ ৭০-৭৫ জনকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু দমানো গেল না আন্দোলন। ১৫ মার্চ তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভায় বঙ্গবন্ধু সভাপতিত্ব করেন।
এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আতœজীবনী’তে লিখেন, “১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ^বিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র সভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসলো সভাপতির আসন গ্রহন করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সাথে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপোস হয়েছে তার সবগুলিই সভায় অনুমোদন করা হল।’
হাসান খান লিখেন , পরবর্তীতে অনেক প্রবীণ নেতা মন্ত্রিত্বের লোভে আন্দোলন ত্যাগ করলেও বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দিন ধার্য করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল জনগণও এগিয়ে আসবে ভাষা আন্দোলনে। কারণ, জনগণ জানে রাষ্ট্রভাষা না হলে জনগণকে দাসত্বের শেকল আবার পরতে হবে। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের সাথে তার যোগাযোগ হতো নিয়মিত। বঙ্গবন্ধুকে তারা খোঁজ-খবর দিতো, বঙ্গবন্ধু পরামর্শ দিতেন। এরমধ্যে তাঁকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয় ঢাকা থেকে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ২০৩ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেলো। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক শ্লোগান।’
ভাষার মিছিলে গুলিতে শহিদ হওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আপনি বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল।’
অনশনের কারণে বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। অসুস্থ বঙ্গবন্ধু গ্রামের বাড়িতে চলে যান। জেল থেকে বের হয়ে তিনি জেনেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে গেছে। ছোট ছোট হাটবাজারেও হরতাল হয়েছে। দেশের লোক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছাড়া উপায় নেই। কেবল তা-ই নয়, যারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বলেছে তারাও ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এর আগে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরপর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’
ভাষা সৈনিক গাজীউল হক তাঁর ‘আমার দেখা আমার লেখা’ গ্রন্থেও লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন : শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।

তথ্য সূত্র :কানাই চক্রবর্ত্তী বাসস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :