April 25, 2024, 9:50 pm

নারীদের ইজ্জত রক্ষার আর্তনাদ

দৈনিক পদ্মা সংবাদ, নিউজ ডেস্ক।
ধর্ষের পর মামলা হয়, আসামিও আটক হয়, আদালতেও বিচার চলে কিন্তু বিচারকের সামনে সাক্ষী হাজির থাকে না, শুধু সাক্ষীর অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে-ড. শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
*দেশে যেভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক রাষ্ট্রের জন্য, আমাদের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে, অপরাধীদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে-গোলাম কুদ্দুস, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি
*ধর্ষণের মতো এই বড় অপরাধটি বেড়ে গেছে, এটি দেশ ও সরকারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়, এভাবে চলতে থাকলে করোনা মহামারির মতো ছড়িয়ে যেতে পারে-খুশি কবির, মানবাধিকার কর্মী
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনসহ সারা দেশে ধর্ষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীর উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে (বামে) এবং শাহবাগ এলাকায় সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা-এম খোকন সিকদার
দেশজুড়ে নারীদের ইজ্জত রক্ষার আর্তনাদ। একের পর এক স্বামীর সামনে স্ত্রী, মা-বাবার সামনে কন্যা ধর্ষণের ঘটনাকে দেশের জন্য করোনার মতো মহামারি দেখছেন দেশের নিরাপত্তা বিষয়ে চোখ রাখা বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে চার যুবকের নির্যাতনের ভিডিওচিত্র সারা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে।
স্বামীর সামনে বিবস্ত্র স্ত্রীর সেই আর্তনাদ ‘এরে আব্বারে! এরে আব্বা! এরে আব্বা! তোর গো আল্লাহর দোহাই, এরে আব্বারে! এরে আব্বারে! এরে আব্বা… তোরগো আল্লাহর দোহাইরে… এরে আব্বারে! এরে তোরগো আল্লাহর দোহাইরে, এরে আব্বারে … এরে আব্বা আব্বা এরে… চার যুবকের অশ্রাব্য ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য কিছু শব্দ… শুধু আমার স্বামী আসে আর কেউ নারে, স্বামীকে নিয়ে গালি অপ্রকাশযোগ্য… এই ধর ধর… এরে আল্লাহরে এরে, আর মারিচ্ছা রু যার গোই, হোতা হোতা… এরে আব্বা এরে আব্বা, তোরগো আল্লাহর দোহাই, এরে ভাইরে এরে আব্বারে তোর গো আল্লাহর দোহাই, ফেসবুকে দিমু ফেসবুক, ফেসবুক! লাঠি দিয়ে… চিৎকার… এরে ভাই ভাই আর দিস না, এরে ভাইরে! এরে ভাইরে! এরে আব্বারে! লাইট…’
এছাড়া সমপ্রতি সিলেটে স্বামীর সাথে সন্ধ্যায় বেড়াতে বের হয়ে এমসি কলেজের হোস্টেলে ও পাহাড়ি এলাকা খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কিশোরীকন্যা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার। ঝিনাইদহে ধর্ষণের পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে হত্যা! সিলেট নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ায় ১৪ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার। ১০ টাকার লোভ দেখিয়ে গোয়ালঘরে নিয়ে শিশু ধর্ষণ। সিলেট নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের এক কর্মী। এই ঘটনাগুলো দেশ ও সরকারের জন্য ভালো লক্ষণ নয় বলে মনে করছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে একের পর এক যেভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক রাষ্ট্রের জন্য। দেশে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে, অপরাধীদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার দাবি উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতার মাধ্যমে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যারা অপরাধ করছে কিংবা ধর্ষণ করছে শুধু সাক্ষীর অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে। মামলা হয় আসামিও আটক হয়, আদালতেও বিচার চলে কিন্তু বিচারকের সামনে সাক্ষী হাজির থাকে না।
সাক্ষীর জন্য বিচারক তিন সপ্তাহ, মাসের পর মাস দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়ে সাক্ষীকে উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেও পুলিশ সাক্ষীকে যথাসময়ে আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়। পুলিশ উপরের মহলের চাপে, কখনো টাকার কাছে লোভে পড়ে সাক্ষীকে আদালতে হাজির করেন না।
এক সময় দেখা যায়, আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমার মক্কেল আর কত জেল খাটবে, কোনো সাক্ষী নেই। তখন বিচারকের ওই অপরাধীকে জামিন দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ পুলিশের উদাসীনতা, ব্যর্থতা আর বিশেষ মহলের প্রভাবের কারণেই ধর্ষণের আসামিরা সময়ের আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরপরই বের হয়ে যাচ্ছে।

সমপ্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ঘরে ঢুকে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে একদল যুবক ও কিশোর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রায় দেড় মিনিটের ওই ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ওই গৃহবধূ নিজের সম্ভ্রম রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু নির্যাতনকারীরা তার পোশাক কেড়ে নিয়ে আপত্তিকর কথা ও নির্যাতন করতে থাকেন। তিনি প্রাণপণে সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করেন, হামলাকারীদের ‘বাবা’ ডাকেন এবং তাদের পায়ে ধরেন। কিন্তু তারা ভিডিও ধারণ বন্ধ করেনি।
বরং এক যুবক কয়েকবার ওই নারীর মুখে লাথি মারে ও পা দিয়ে মুখসহ শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় লাঠি ও লাইট দিয়ে নির্যাতন করেন। আঘাত করতে করতে নগ্ন ছবি ধারণ করে। নির্যাতিতার বাবা বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেননি তারা। ওই যুবকদের ভয়ে ঘটনার পর তার মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
একলাশপুর ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ওই নারীর ১৮ বছর আগে বিয়ে হয়। তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় কয়েক বছর আগে তিনি বাপের বাড়ি চলে আসেন। তার এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে ওই নারী ছেলে ও এক ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন।
সমপ্রতি তার স্বামী তার কাছে আসা-যাওয়া করতে শুরু করেন। এ নিয়ে কয়েক যুবক আপত্তি জানিয়ে সেদিন ওই নারীকে নির্যাতন করে। ঘটনার দিন ওই নারী তার স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন। নির্যাতনকারীরা তার স্বামীকেও আটক করে নিয়ে যায়। পরে ওই নারীর ভাই এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, যারা অপরাধ করছে, কিংবা ধর্ষণ করছে শুধু সাক্ষীর অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে। মামলা হয়, আসামিও আটক হয়, আদালতেও বিচার চলে কিন্তু বিচারকের সামনে সাক্ষী হাজির থাকে না। এই সাক্ষী কে নিয়ে আসবে? নিশ্চয়ই পুলিশ নিয়ে আসবে। কিন্তু আনা হয় না।
সাক্ষীর জন্য বিচারক তিন সপ্তাহ, মাসের পর মাস দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়ে সাক্ষীকে উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেও পুলিশ সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়। আদালত ন্যায়বিচারের জন্য কোনো সাক্ষীকে নিয়ে আসতে পারেন না। সাক্ষীকে নিয়ে আসবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদি স্পষ্টই বলতে হয়— সেই পুলিশ উপরের মহলের চাপে, কখনো টাকার কাছে লোভে পড়ে সাক্ষীকে আদালতে হাজির করেন না।
এক সময় দেখা যায়, আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমার মক্কেল আর কত জেল খাটবে, কোনো সাক্ষী নেই। তখন বিচারকের ওই অপরাধীকে জামিন দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ পুলিশের উদাসীনতা, ব্যর্থতা আর বিশেষ মহলের প্রভাবের কারণেই ধর্ষণের আসামিরা সময়ের আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বের হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া আমরা এও দেখছি এখন অনেকে আর সত্য বলতে চায় না, সত্য বললে কাউকে তুলে নেয়া হচ্ছে, কারো বাড়িতে হামলা করা হচ্ছে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা অর্থাৎ ধর্ষণ, খুন, অপরাধ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সকল দেশেই হচ্ছে। যেমন নিউইয়র্কে ৭০ লাখ মানুষের মধ্যে ১২ হাজার লোকের মাঝে এমন ঘটনা ঘটেছে। ম্যাক্সিকোতে মাসে প্রায় ৩২ হাজার লোকের মধ্যেই এমন ঘটনা ঘটে। আর বাংলাদেশে এটি চার হাজারের মতো যা পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের চেয়েও কম।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস আমার সংবাদকে বলেন, একের পর এক দেশে যেভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক রাষ্ট্রের জন্য। এ নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলবে। আগামীকাল (আজ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমাদের প্রতিবাদ অবস্থান থাকবে। আমরা এসব নির্যাতনকারীর কঠিন শাস্তি চাই। আজকে যে একের পর এক ধর্ষণ হচ্ছে আমি বলবো— মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে, অপরাধীদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতার মাধ্যমে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির আমার সংবাদকে বলেছেন, দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় আমরা কষ্ট পাচ্ছি। ধর্ষণের মতো এত বড় অপরাধটি অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। এটি দেশ ও সরকারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এভাবে চলতে থাকলে এটি করোনা মহামারির মতো ছড়িয়ে যেতে পারে। আমরা দেখেছি গত এক মাসে এমন প্রায় ৩৫টি ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এগুলো ভাইরাল হওয়ায় আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু যেগুলো প্রকাশ পাচ্ছে না তা আমরা জানতে পারছি না। তবে এটি ঠিক ধর্ষকের কোনো পরিবার নেই। আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাবো— এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা অনেক সময় দেখি ঘটনার সঙ্গে যারা মৌলিকভাবে জড়িত থাকেন তারা অন্তরালে থেকে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :