‘‘যৌন ও পায়ু পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হয় আনুশকার- ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ’’
‘‘সম্মতিতেই শারীরিক সম্পর্ক, অন্য কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে কিনা দেখা হচ্ছে- ডিসি রমনা ’’
‘‘বিচারিক দুর্বলতার কারণেই ধর্ষণ থামছে না- অধ্যাপক জিয়া রহমান, অপরাধ বিজ্ঞানী, ঢাবি ’’
‘‘সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই ধর্ষণ বাড়ছে- ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ’’
‘‘সম্মতি থাকলেও নিজস্ব বোঝাপোড়ার মাধ্যমেই নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে- নুর খান লিটন, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, আসক’’
‘‘তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যেমন সুফল পাচ্ছি, তেমনি কুফলও পাচ্ছি- অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক’’
গত এক থেকে দেড় যুগ ধরে দেশে ধর্ষণ-গণধর্ষণের যে সংস্কৃতির চালু হয়েছে তা পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতাবোধের সংকটেই বলছেন মানবধাকিার কর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, আইনজীবি ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা। নৈতিকতাবোধের সংকট এতোটাই তীব্র হয়েছে যে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখে আইনের সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা হলেও বিচারে প্রভাব পড়েনি মোটেও বরং তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিকৃতই হচ্ছে মস্তিস্ক, নৈতিক সত্তাকেও অবদমন করে ঘটাচ্ছে মুল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়। আর নৈতিকতার অবক্ষয় ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতারই ফল সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কলাবাগানের ডলফিন গলিতে ঘটে যাওয়া ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ও লেভেল পড়–য়া ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা। পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজে স্কুল ছাত্রীই নয় শুধু কোনো নারীই আজ নিরাপদ নয় বন্ধু কিংবা সহপাঠীর কাছেও- এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তেমনি বিবেক-মস্তিস্ক বর্জিত ইফতেখার দিহানের কাছেও নিরাপদ ছিল না আনুশকা আমিন অর্ণার জীবনও। পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী উভয়ের সম্মতিক্রমেই শারীরিক সম্পর্ক হয়ে থাকলেও দিহানের মধ্যে জেগে উঠেছিল ভোগবাদী সত্তা, যার ফলশ্রুতিতেই বিকৃত যৌনাচারের কারনেই অতিরিক্ত রক্তক্ষণে মৃত্যু হয় আনুশকার- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদের বক্তব্যেও উঠে আসে এমনটাই। ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ধর্ষণের ফলে যৌন ও পায়ু পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হয়েছে আনুশকার।
এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান আমার সংবাদকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতা এবং বিচারিক দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মত ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমরা একটা অস্থির সময়ে বাস করছি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সামাজিক অস্থিরতার ফলে মানুষের মানবিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, ইন্টারেটে অবাধ বিচরনের কারণে সমাজে যেসব বিষয় আসছে, সেগুলো ধারণের মতো মানসিক সক্ষমতা আমাদের নেই। এ কারণে ধর্ষণই শুধু নয়, অন্যান্য অপরাধও বাড়ছে। আমাদের মনস্তত্ত্বে যে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর উত্তরণ প্রয়োজন। সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিতে হবে। যৌন বিষয়ক শিক্ষা নিয়েও আমাদের দেশে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ এগুলো আধুনিক সমাজের পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধীরে ধীরে ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে সে অবস্থায় আমাদের পৌঁছাতে হবে।
এদিকে গতকাল বিকেলে ধর্ষণের পর হত্যার মামলায় একমাত্র অভিযুক্ত তানভীর ইফতেফার দিহান দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এরআগে তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হলে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় তা রেকর্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পুলিশ পরিদর্শক আ ফ ম আসাদুজ্জামান। আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ তার জবানবন্দি রেকর্ড করে দিহানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও নারী অধিকারে সোচ্চার, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুরালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ আমার সংবাদকে বলেন, বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারনে ধর্ষণ বাড়ছে। আবার ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয় কিন্তু বিচার হওয়ার নজির খুব কম। এতে ধর্ষকদের মাঝে ভয় কম থাকে যার ফলে এমন ঘটনা ঘটাতে পরোয়া করে না। আর ‘নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনার পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। গোটা সমাজ ব্যবস্থা হতাশাগ্রস্ত। সামাজিক মোরালিটিতেও ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয় বেড়েছে। নারীর পদচারণা বাড়লেও তাদের অগ্রগতি কিংবা নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত সেভাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা যায়নি। নারীকে ঘরে কিংবা বাইরে মানুষ হিসেবে দেখার মতো মানসিকতা আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। সেই জায়গাটায় পরিবারের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
আনুশকার মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার দিহান দাবি করেছে পারস্পরিক সম্মতিতেই তার সঙ্গে আনুশকার শারীরিক হয়েছে। শারীরিক সম্পর্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হলে আনুশকাকে আনোয়ার খান মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায় সে। এ বিষয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান জানান, আনুশকাকে ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় আলামত সংগ্রহ করছে সিআইডি।
এ ছাড়া দিহানের নামে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করেন, সে জন্য অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি । তিনি বলেন, দৈহিক মেলামেশাকালে অন্য কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সেটার জন্য আমরা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট করতে দিয়েছি।
তবে মানবাধিকারকর্মী আইন ও সালিক কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন আমার সংবাদকে বলেন, দেশে যেভাবে নানা ধরণের অপরাধ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে পারিবারিক যে নৈতিকতা এবং সমাজের যে নৈতিকতা- এ জায়গাটাতে ধর্ষণ এসেছে গত এক-দেড় যুগ ধরে। এখানে একটা মেয়েও কিন্তু তার সহপাঠীর কাছে নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে সমাজের নৈতিকতাবোধ, পরিবারের নৈতিকতাবোধ যদি আনা যায়, সচেতনতা তৈরি করা যায় মানুষের মধ্যে, তাহলে এ ধরণের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। অন্যথায় এটা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। যদি সম্মতিতেও হয় আর যদি সে প্রাপ্ত বয়স্ক না হয় তাহলে এটা একটা অপরাধ। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে থাকলে অন্যভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই বা কেন হবে আর এ ধরণের অবস্থাই বা কেন হবে। সেখানে নিরাপত্তার একটা বিষয় কিন্তু সামনে আসার কথা। সেক্সুয়াল হোক আর যেকোনো ঘটনাই হোক সম্মতি সাপেক্ষেও যদি হয়ে থাকে সেখানেও কিন্তু নিরাপত্তার বিষয় আছে। এটি যখন গুরুত্ব না পায় তখন বর্বরতার সৃষ্টি হবেই।
নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, নিজস্ব বোঝাপোড়ার মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। এটা কেন হচ্ছে না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যখন পারিবারিক নৈতিকতা এবং সামাজিক নৈতিকতাবোধ মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে যায় তখনই এ ধরণের ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। সুতরাং একটা নৈতিকতা বোধের ওপরে পরিবার এবং সমাজকে দাঁড়াতে হবে। এর বিকল্প নেই।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলছেন, যারা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে, তাদের বিবেকবোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা মোটেও নেই। আমরা তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যেমন সুফল পাচ্ছি, পাশাপাশি পাচ্ছি কিছু কুফলও। এখন অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে এক ক্লিকেই যেকোনো অশ্লীল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারে, যা তাদের মস্তিষ্কে ছাপ ফেলছে, ভোগবাদী সত্তাকে জাগিয়ে তুলছে এবং তাদের নৈতিক সত্তাকে অবদমন করছে। এ কারণেই মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে।
Leave a Reply