দৈনিক পদ্মা সংবাদ ডেস্ক।।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নের নান্দুরা গ্রামের মো. এরশাদুল হক (৩৫) ও একই গ্রামের বাদল সরকারকে (২৩) খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডে ১৫ জনের মতো অংশ নেয়। মোটরসাইকেলে করে আসা ওই দুর্বৃত্তরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মোটরসাইকেলে করেই সটকে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, পূর্ব বিরোধের জের ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। প্রায় আড়াই বছর আগে এরশাদুলের চাচাতো ভাই মো. সাইফুল্লাহকে গ্রাম্য আধিপাত্য বিস্তারের ঘটনায় হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডসহ দুই মামলার বাদী ছিলেন এরশাদুল হক। একইভাবে এরশাদুল হকের বিরুদ্ধেও নবীনগর থানায় দু’টি মামলা রয়েছে। ষষ্ঠ ধাপে নাটঘর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা। এরশাদুলের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিপক্ষের লোকজন পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে পরিবারের লোকজন ও স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
নিহত এরশাদুল নাটঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেমের ছেলে ও আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী। বাবার অসুস্থতার কারণে তিনি এ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছিলেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এরশাদুল। নিহত বাদল সরকার ব্যবসায়িকসহ ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে এরশাদুলকে সহায়তা করতেন। সন্তোষ সরকারের ছেলে বাদল সরকারই মোটরসাইকেলে করে এরশাদকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি এরশাদুলের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে শনিবার দুপুরে বাদল সরকারের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। বেলা ৩টার দিকে তাঁর লাশ বাড়িতে নেওয়া হলে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শত শত মানুষ লাশ দেখতে ভিড় জমায়। একই সময়ে এরশাদুলের লাশ নিয়ে ঢাকা থেকে স্বজনরা রওয়ানা হয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। দুজনের বাড়িতেই চলছে শোকের মাতম। পরিবারের একাধিক সদস্য বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন।
শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। তবে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে একজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে আটক হওয়া ব্যক্তির নাম প্রকাশ করতে চায়নি পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পর পরই আট-দশটি বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। এ অবস্থায় ওইসব বাড়িঘরের মানুষজন পালিয়ে গেছে। শনিবার দুপুরে ওই এলাকায় সরজমিনে গিয়ে এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিহতদের এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কুড়িঘর বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। শনিবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মো. হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ঘটনাস্থলসহ নিহতদের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তাঁরা হত্যাকারীদের খোঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন।
এলাকাবাসী, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার রাতে নাটঘর ইউনিয়নের কুড়িঘর এলাকায় দু’টি ওয়াজ মাহফিল চলছিল। দুটিতেই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে নিজের জন্য দোয়া চান এরশাদুল। পাশাপাশি আর্থিক অনুদানও ঘোষণা করেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে তিনি প্রতিবেশী ও ঘনিষ্টজন বাদল সরকারকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাদল মোটরসাইকেলে চালাচ্ছিলেন। কুড়িঘর বাজার পার হওয়ার পর মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন প্রথমে বাদলকে গুলি করেন। পরে এরশাদুলকে গুলি করা হয়। বাদলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকায় নেওয়ার পথে রাত দেড়টার দিকে মারা যান এরশাদুল।
এদিকে এরশাদুলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই নান্দুরা গ্রামের আবু নাসেরের গোষ্ঠীর চারটি ঘর, সফরের গোষ্ঠীর পাঁচটি ঘর ভাঙচুর ও মালামাল লুট হয়। এ সময় খায়ের মিয়ার বাড়ির তিনটি গরুও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ হামলার পর ওইসব বাড়ির লোকজন পালিয়ে যান।
দুজনের ওপর হামলার ঘটনা সম্পর্কে এরশাদুলের চাচাতো ভাই কাতার প্রবাসী মো. আক্তারুজ্জামান জানান, ওয়াজ মাহফিলে যোগ দিয়ে কুড়িঘর বাজারে বিশ্রাম নেন এরশাদুল। সেখান থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর দূর থেকে মোটরসাইকেলের আলোয় দেখতে পারেন পূর্বমুখী হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ১৫ জনের মতো দাঁড়ানো। হুট করে দু’পাশ থেকে তারা গুলি শুরু করে। তিনি তাদেরকে ধরার চেষ্টা করেও পারেননি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে ১০-১২ জনকে আমি চিনতে পেরেছি। তারা সবাই আমাদের এলাকার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমি তাদের নাম বলবো। আমি ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করছি।’
কুড়িঘর গ্রামের বাসিন্দা মো. মনির বলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে দৌঁড়ে আসি। আমার এক ভাতিজা তখন চিৎকার করে বলতে থাকে এরশাদ ভাইকে মেরে ফেলছে। আহত এরশাদ ভাইকে একটি অটোরিকশায় তুলে দেই। বাদল সরকার তখন সড়কে পড়েছিল। পরে খবর পেয়ে পুলিশ আসে।’
এরশাদুলের বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমরা কাউকে কোনো কটূক্তি করিনি। কিন্তু অন্যরা বিভিন্ন কথা বলে থাকে। কিন্তু এতে আমরা মাথা ঘামাই না। নির্বাচন ছাড়া আর কোনো বিরোধ আমার নেই। আমার ছেলে জনপ্রিয়তা অর্জন করাতেই এটা করানো হয়েছে। যারাই এটা করুক আমি তাদের বিচার চাই। লাশ দাফন করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান, পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যান্য বিষয়ও মাথায় রেখে এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। লিখিত অভিযোগ পেলে সে অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।।
Leave a Reply