দৈনিক পদ্মা সংবাদ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উন্নত জাহাজ, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সক্ষমতা আরো বাড়ানো পরিকল্পনা তাঁর সরকারের রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভবিষ্যতে আরও অধিক উন্নত মানের জাহাজ এবং আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজনের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’
শেখ হাসিনা আজ সকালে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ‘মিডশিপম্যান ২০১৯ আলফা’ এবং ‘ডিইও ২০২১ ব্রাভো’ ব্যাচের শীত কালীন রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি’র ভাষণে এ কথা বলেন।
সততা, সঠিক নেতৃত্ব ও আত্ম ত্যাগ এই ত্রি-মাত্রিক মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের প্রয়োজনে নৌ বাহিনীর সদস্যদেরও সদা প্রস্তুত থাকারও আহবান জানান তিনি।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের সাহায্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গাস্থ বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি’র মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাবমেরিন ও যুদ্ধ জাহাজসমূহকে পোতাশ্রয়ে নিরাপদ জেটি সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে কক্সবাজারের পেকুয়াতে আধুনিক বেসিন সুবিধা সম্বলিত স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি ‘বানৌজা শেখ হাসিনা’ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উপকূলবর্তী এলাকায় নৌ বাহিনীর জাহাজসমূহের অপারেশানাল ও যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ‘শের-ই-বাংলা ঘাঁটি’র নির্মাণ কাজ অনেক দূর এগিয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন নতুন জাহাজ এবং সমরাস্ত্র সংযোজনের পাশাপাশি এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো বৃদ্ধি এবং সময়োপযোগী করার ক্ষেত্রেও আমাদের সরকার কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নৌ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা’র পদনাম পরিবর্তন করে ‘কমান্ডার ঢাকা নৌ অঞ্চল’ করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে পদবি কমডোর থেকে রিয়ার এডমিরালে উন্নীত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পাসিং আউট ক্যাডেটদের মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন এবং কুচকাওয়াজ থেকে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়।
এদিন, প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ৪৪ জন প্রশিক্ষনার্থী কমিশন্ড অফিসার হিসেবে কাজে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল এম শাহীন ইকবাল চৌকস ক্যাডেটদের অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ তাদেরকে পুরস্কারে ভূষিত করেন।
নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল এম শাহীন ইকবাল অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ ও জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ তোমাদের চমৎকার কুচকাওয়াজ উপভোগ করতে পেরে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে চলমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তোমরা তোমাদের অদম্য আগ্রহ, দৃঢ় মনোবল ও সাহসী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছ। আমি আশা করি, চাকুরি বা ব্যক্তিগত জীবনের যে কোন সংকটে তোমরা এ ধরনের সুবিবেচনা ও নেতৃত্বসুলভ গুণাবলীর পরিচয় দেবে।
তিনি বলেন, কর্মজীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে তোমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তোমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি, আমরা বিজয়ী জাতি এবং বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা বিশে^ মাথা উঁচু করে চলবো।
প্রশিক্ষণকে তিনি সবসময় গুরুত্ব দেন করেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তোমাদের মনে রাখতে হবে যে কঠোর প্রশিক্ষণ তোমরা শেষ করলে তা তোমাদের উৎকর্ষ অর্জনের সূচনা মাত্র। সততা, সঠিক নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের প্রয়োজনে তোমাদের সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। আমি আশা করবো তোমাদের দেশপ্রেম, শৃঙ্খলাবোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা তোমাদের অধিনস্তদেরও একইভাবে দেশের প্রয়োজনে আত্মনিবেদনে অনুপ্রাণিত করবে।
নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে তাঁর সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপের বিস্তারিত উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, গত নভেম্বর ২০২১ জার্মানী থেকে নতুন একটি এমপিএ বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর এভিয়েশন উইং এ যুক্ত হয়েছে এবং অপরটি আগামী ২০২২ সালের মে মাসে যুক্ত হবে। হেলিকপ্টার এবং এমপিএ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আধুনিক সকল সুবিধা সম্বলিত দ্বিতীয় হ্যাঙ্গারের নির্মাণ কাজও চলমান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ইতোমধ্যে প্যাট্রোল ক্রাফট ও লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ নৌ বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডে আধুনিক যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ‘ক্রেতা নৌ বাহিনী’ থেকে ‘নির্মাতা নৌ বাহিনী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে চাই যে, ২০১৭ সালে নৌ বহরে ‘বানৌজা নবযাত্রা’ এবং ‘বানৌজা জয়যাত্রা’ নামক দু’টি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে একটি সত্যিকারের পূর্ণাঙ্গ ত্রি-মাত্রিক নৌ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর সরকার বাংলাদেশ নৌ বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, মেরিটাইম প্যাট্রোল এয়ারক্রাফট এবং সাবমেরিনসহ আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সংযোজিত করেছে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পূণর্গঠনকালে নৌ বাহিনীর সম্প্রসারণে জাতির পিতার ভূমিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস এন্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন, যা ছিল বাংলাদেশের সমুদ্র নীতির ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা সুনির্দিষ্টকরণ সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে তাঁর সরকার জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে।
দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুগোপযোগী একাডেমি প্রতিষ্ঠা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে নেভাল একাডেমীতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা স¤¦লিত ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ উদ্বোধন করা হয়ছে।
তিনি বলেন, এই কমপ্লেক্সের মাধ্যমে নেভাল একাডেমিতে প্রশিক্ষণ সুবিধা আজ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরিতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইতোমধ্যে একাডেমিতে স্মল আর্মস ফায়ারিং, মোটর ড্রাইভিং এবং ব্রীজ সিমুলেটর স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এই বর্ধিত সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তাগণ অধিকতর আত্মবিশ্বাসী হয়ে নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে নৌ বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আজ শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিম-লেও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, দক্ষ এবং পেশাদার বাহিনী হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ সকল ক্ষেত্রে তাঁদের আত্মত্যাগ ও কর্তব্যনিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরল সম্মান ও মর্যাদা, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশ নৌ বাহিনীসহ আমাদের সশস্ত্র বাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি পাসিং আউট ক্যাডেটদের অভিভাবকদেরকেও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আপনারা দোয়া করবেন যেন, আপনাদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের এক একজন গর্বিত সন্তÍানে পরিণত হয়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারে।
Leave a Reply