মোঃ শহিদুল ইসলাম, কোটচাঁদপুর প্রতিনিধি।।
বর্তমানে দেশের কৃষি প্রধান অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের জনপদের চিত্রও অভিন্ন। একসময় নদী, বিল ও গ্রামীণ পলিবাহিত উর্বর কৃষিনির্ভর এই জনপদের মানুষদের কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙতো লাঙ্গল জোয়াল আর হালের গরুর মুখ দেখে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সেই জনপদের মানুষদের ঘুম ভাঙে ট্রাক্টরের শব্দে। জেলার গ্রামীণ কৃষকের ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষের একমাত্র অবলম্বন ছিল গরু বা মহিষ দিয়ে হালচাষ। গ্রামবাংলার কৃষকের হাজার বছরের লালন করা ঐতিহ্য গরু দিয়ে হালচাষ যন্ত্রনির্ভর প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন বিলুপ্তির পথে।
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, একসময় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল পরিবারের এক একটা সদস্যের মতো গরুর লালন-পালন। তাদের একের পর এক জমি চাষ করার কাজে ব্যবহার করা হতো। তাজা ঘাস আর ভাতের মাড়, খৈলের ভুসি ইত্যাদি খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা হালের জোড়া বলদ দিয়ে জমি চষে বেড়াতেন কৃষক। হালচাষের জন্য প্রশিক্ষিত জোড়া বলদের মালিককে সিরিয়াল দিতে হতো জমি চষে দেয়ার জন্য। চাষের মৌসুমে তাদের কদর ছিল অনেক। হালচাষের জন্য বাণিজ্যিকভাবে গরু-মহিষ পালন করা হতো। মাঠ-প্রান্তরে হরহামেশাই চোখে পড়ত গরু দিয়ে হালচাষ। নিজের সামান্য জমিতে হালচাষের পাশাপাশি জীবিকার উৎস ছিল। এসব চিত্র এখন দেখা যায় না।
উপজেলার পৌর এলাকার কৃষক রফিক মন্ডল বলেন, তার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে হালচাষ আর গরুর পালের সঙ্গে। সেই দিনগুলো এখন অতীত স্মৃতি। তিনি আরও বলেন, লাঙলের ফলায় জমি গভীর পর্যন্ত ওলট-পালট হয়ে নিচের পুষ্টিগুণ ওপরে চলে আসে। বাতাস সহজে চলাচলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ও মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
প্রাকৃতিক চাষাবাদে কেঁচোসহ উপকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয় না, জমিতে ঘাস কম হয়, গরুর গোবর জমিতে পড়ে জৈব সারে ফসল ভালো হতো। স্বল্প সময়ে জমি চাষ হলেও জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।
কাশিপুর গ্রামের ইউনুস আলী বলেন,ছোট থেকেই দেখেছি বাপ-দাদারা ফজরের আযানের ধ্বনির পর পরই কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল, মই, গরু নিয়ে মাঠে যেত হালচাষের জন্য। সকালে বৌয়ের হাতের এক থালা পান্তা, কাঁচা ও পোড়ানো শুকনো মরিচ, খাঁটি সরিষার তেল, আলুর ভর্তা দিয়ে পাঠালে জমির আইলে বসে পেট ভরে খেত। এ ঐতিহবাহী খাবারের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে চাষের বলদ ও লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ।
কুশনা ইউনিয়নের বহরমপুর গ্রামের কৃষক লিটন বলেন, ছোট বেলা থেকে হালচাষের কাজ দেখভাল করতেন। বর্তমান সময়ে ট্রাক্টরের দাপটে এখন আর গরু দিয়ে হালচাষ হয় না বললেই চলে। অনেকেই এখন গরু পালন ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আমরা সেই পুরনো স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে করে সময় পার করছেন।
কোটচাঁদপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর খোন্দকার শারাফৎ হোসেন বলেন , আধুনিকতার ছুঁয়ায় মানুষ যেভাবে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, এতে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখা খুবই দুরূহ ব্যাপার। তবুও গ্রাম অঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে আমাদের কৃষকরা এ ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
অবশ্য ট্রাক্টরে সুবিধা অনেক। গরুর হালে এক একর জমি চাষে হাঁটতে হয় প্রায় ২০ কিলোমিটার। আর ট্রাক্টরে তা মাত্র ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার।
বর্তমানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষি ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য নিয়ে এসেছে বলে জানান কোটচাঁদপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ মহাসিন আলী বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। অল্প পরিশ্রমে, স্বল্প সময়ে অধিক ফসল ফলাতে মানুষ এখন যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য গরু দিয়ে হালচাষ।
বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙল জোয়াল, মই, গরু ও মহিষ। বর্তমান যুগে কৃষকরাও ঝুঁকছেন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষাবাদে। হয়তো এই সনাতনী পদ্ধতির হালচাষ একদিন কৃষকের জীবন থেকে উঠে আসবে গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমায়। আধুনিক সমাজে পৌঁছে যাবে শিল্পীর চিত্রকর্মে বইয়ের প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে।
Leave a Reply