আজ ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কেন আত্মহত্যা বাড়ছে?

অনলাইন ডেস্ক।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন৷ আর বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা৷ এমনকি বিত্তবানেরাও আত্মহত্যা করছেন৷ আত্মঘাতী হওয়ার এই প্রবণতা কেন?সম্প্রতি ঢাকায় ফেসবুক লাইভে এসে আবু মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ীর নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে৷ উঠে এসেছে নগর জীবনের নিঃসঙ্গতার কথ৷ তিনি চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর হওয়ায় আলোচনাটা হয়তো একটু বেশি হয়েছে৷অবশ্য এটাই প্রথম নয়৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বলা যায় ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে৷ গত বছরের ১৭ আগস্ট মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের গয়ঘর এলাকায় সুমন নামের এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন৷ একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ফেসবুক লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন পুবাইলের স্বপন চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী৷ ৭ ডিসেম্বর সবুজ সরকার নামে কুমিল্লার এক তরুণ ফেসবুক লাইভে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন৷বিবিএস-এর জরিপ বলছে বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ৷ গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৩৫ জন৷পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন৷ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে দুই হাজার ১৬৬টি৷আর আত্মহত্যার হার দিন দিন বাড়ছে৷ বিশেষ করে করোনার সময় এই প্রবণতা বেড়ে গেছে৷বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ৷ মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি৷ করোনার সময় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে৷বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করেন৷ দৈনিক আত্মহত্যা করেন দুই হাজার ১৯১ জন৷ প্রতি লাখে ১৬ জন৷জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা.
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যদি এই সময়ে আলোচিত আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে হঠাৎ করে নয়, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ তার মৃত্যুর পর মানুষ কীভাবে ঘরে ঢুকবে তার ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন৷ এটা একাকীত্ব থেকে গভীর বিষন্নতার ফল৷তিনি বলেন, ‘‘আবার ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার একটি ঘটনা যখন প্রচার পায় তখন অন্যদের প্রভাবিত করে৷ আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে যদি পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয় তাহলে আরেকজন আত্মহত্যার যুক্তি খুঁজে পায়৷ তাই আমাদের সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন৷’’মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারেন না৷ পৃথিবীতে নগরেই আত্মহত্যা বেশি ঘটে৷ বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে৷ প্রযুক্তি মানুষকে যেমন সচেতন করে তেমনি আত্মহত্যাপ্রবণ করে৷ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মহত্যার মধ্যে কেউ ‘বীরত্ব’ খুঁজে পেতে পারেন বলে মনে করেন এই মনোচিকিৎসক৷সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.
নেহাল করিম মনে করেন আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে৷ আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বের চিত্র৷ এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন তখন আত্মঘাতী হন৷ তবে এইসব কারণের মূল উপাদান রাষ্ট্র ও সমাজেই বেশি৷তিনি বলেন, ‘‘এই করোনায় মানুষের সংকট বেড়েছে৷ বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে৷ জীবন নিয়ে সংশয় বেড়েছে৷ বেড়েছে দারিদ্র, হতাশা, শূন্যতা৷ এটা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি৷ যার ফল আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়া৷ পরিবার রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে৷ কাউন্সেলিং-এর সুবিধা বাড়াতে হবে৷ সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে৷’’গত বছর বাংলাদেশে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন তাদের জরিপে এই তথ্য জানিয়েছে৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান তানসেন রোজ জানান, ‘‘করোনার সময় তরুণদের মধ্যে বিচ্ছন্নতা বেড়েছে৷ ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েছে৷ আর পরিবারগুলো যারা আর্থিক চাপে পড়েছে তাদের চাপ পড়েছে পরিবারের তরুণ সদস্যদের ওপর৷ একাকিত্বে প্রযুক্তির অপব্যবহার তাদের চরম হতাশার মধ্যে ফেলেছে৷ যার নির্মম পরিণতি আমরা দেখেছি৷ তরুণদের পাশে দাঁড়াতে হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কউন্সেলিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে৷ আর তাদের হতাশার জায়গাগুলো দূর করে তাদের সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী করতে হবে৷ তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না৷ যাবে না অবহেলা করা৷’’রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, কোভিড অতিমারির সময় বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে৷ডা.
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘করোনায় যারা বিষাদ বা হতাশার শিকার হয়েছেন তারা সবাইতে আত্মহত্যা করেননি৷ সুতরাং এখানেই জীবনের প্রতি ভালোবাসার গল্প আছে৷ আমাদের সেটাই বড় করে দেখানো উচিত৷ তারা তো হতাশাকে জয় করেছেন৷ যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে যথাসময়ে এই জীবনবোধ জাগাতে পারলে দুঃখজনক পরিণতি দেখতে হতো না৷’’প্রতিবেদন: হারুন উর রশীদ স্বপন (ঢাকা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :