আজ ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাবার ওপর ক্ষোভ মেটাতেই ছেলে হুরায়রাকে পরিকল্পিত হত্যা:হত্যাকারী মোমেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: দু’বছর আগের ওই ঘটনারই বদলা নিতে অপহরণের পর খুন করা হয় চুয়াডাঙ্গা তালতলার আব্দুল বারেকের একমাত্র ছেলে আবু হুরায়রাকে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে এমনই তথ্য দিয়েছেন হত্যাকারী আব্দুল মোমেন। গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবু তারেক।
ঈদের আগের রাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে অনুষ্ঠান করছিলেন মোমেন। নিষেধ করা সত্ত্বেও গান বাজানোর সময় সেখানে গিয়ে সাউন্ডবক্সের টেবিলে লাথি দেন প্রতিবেশী আব্দুল বারেক। ভেঙে যায় টেবিল। প- হয়ে যায় অনুষ্ঠান। এতে তিনহাজার টাকা ক্ষতি হয় মোমেনের।
এদিকে, গতকাল সোমবার দুপুরের পর গ্রেফতারকৃত মোমেনকে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। এর আগে শিশু হুরায়রার পিতা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয় মোমেনকে। দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় মোমেন। তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুল ইসলাম। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। অপরদিকে, শিশু আবু হুরায়রার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোমবার সকালে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে তার স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্ররা। ময়নাতদন্তের পর সোমবার বিকেলে আবু হুরায়রার মরদেহ গ্রামের গোরস্তানে দাফন করা হয়েছে। এছাড়াও সকালে হত্যাকারী আব্দুল মোমেনের বাড়িতে হামলা চালায় তালতলা গ্রামের উত্তেজিত জনগণ। এ সময় বাড়ি ভাঙচুর ও মোমেনের মাকে মারধর করা হয়। পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। মোমেনের মাকে উদ্ধার করে নেয়া হয় থানায়।

গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ১৯ জানুয়ারি বিকেলে বাড়ির পাশে পড়তে যায় আবু হুরায়রা। সেখানে ব্যাগ রেখেই খেলতে বের হয় সে। এ সময় তাকে একা পেয়ে খরগোশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তালতলা সরকারি কবরস্থানে নিয়ে যান মোমেন। পরে আবু হুরায়রাকে হাত-পা বেঁধে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন তিনি। হত্যার পর প্রথমে মরদেহ রেখে চলে যান মোমেন। পরে রাত ৮টার দিকে আবারও কবরস্থানে গিয়ে একটি পুরোনো কবরে হুরায়রার মরদেহ মাটিচাপা দিয়ে পুঁতে রাখেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবু তারেক জানান, হত্যাকা-ের কয়েকদিন পর প্রতিবেশীর সিমকার্ড চুরি করেন মোমেন। এরপর গত ২৯ জানুয়ারি স্কুলছাত্রের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ বাবদ চিরকুট দিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। ১ ফেব্রুয়ারি চিরকুট দিয়ে মোবাইল নম্বর দেয়। চিরকুটে লেখা ছিল (হুবহু), ‘বাকের তোর ছেলে এখনও বাচিয়ে রেখেছি। দশ লাখ টাকা তোর কাছে রাখবি। কখন কিভাবে নেবো পরবর্তী চিঠিতে জানাবো। তুই ব্যতীত কেউ জানলে তোর ছেলের লাশও খুঁজে পাবি না। প্রশাসনের আশ্রয় নিলে তোর ক্ষতি হবে। ইতি সাহেব শিকদার।’ এরপর এসএমএস দিয়ে পুনরায় চাঁদা দাবি করে। পরের দিন স্কুলছাত্রের পরিবার মুক্তিপণ বাবদ ৫ লাখ টাকা দিতে চাইলেও ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি একটি মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে চাঁদা চাওয়া হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তিপণের জন্য ৬ লাখ টাকা দাবি করে অভিযুক্ত মোমেন। চিরকুট ও মোবাইল নম্বর স্কুলছাত্রের পরিবার পুলিশকে দেয়।

এরপর মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে গত রোববার রাতে তালতলা গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে আব্দুল মোমেনকে নিজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করে মোমেন। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে তালতলা কবরস্থানে তল্লাশি চালানো হয়। মোমেনের দেখানো স্থান থেকে অর্থাৎ একটি পুরোনো কবর থেকে আবু হুরায়রার মুখ বাঁধা অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে সোমবার দুপুরে আবু হুরায়রার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিকেলে গ্রামের ওই সরকারি কবরস্থানে আবু হুরায়রার অর্ধগলিত লাশ দাফন করা হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, ‘আবু হুরায়রা হত্যাকা- নিয়ে আমরা এখনও কাজ করছি। হত্যার দোষ স্বীকার করা মোমেন ছাড়াও অন্য কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে কি না আমরা তাও খতিয়ে দেখছি।’ তিনি জানান, ‘মোমেন আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করে স্বাকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। প্রথম শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুল ইসলাম তার জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন। পরে মোমেনকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।’

হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আনিছুজ্জামান, সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসীন, পুলিশ পরিদর্শক সুখেন্দু বসু, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সাইদুজ্জামান ও এসআই গোপাল চন্দ্র ম-ল নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) আনিসুজ্জামান, সদর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, গত ১৯ জানুয়ারি বুধবার বিকেলে নিখোঁজ হয় চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার তালতলা গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল বারেকের ছেলে ও চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আবু হুরায়রা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে না আসায় তাকে খুঁজতে বের হয় পরিবারের লোকজন। রাতে খবর দেয়া হয় পুলিশকে। মাইকিংও করা হয়। ওই রাতে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন আব্দুল বারেক। বাড়ির পাশে পুকুরে পড়ে নিখোঁজ হয়েছে সন্দেহে পরদিন সন্ধ্যার পর দীর্ঘসময় ধরে পুকুর তল্লাশি করেও তার সন্ধান পায় না ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। গত ২৫ জানুয়ারি রাতে প্রাইভেট শিক্ষক রনজুসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন আবু হুরায়রার বাবা আব্দুল বারেক। পরে অভিযান চালিয়ে এজহারভুক্ত আসামি রনজু হক ও মনজু হককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তেমন কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ। পরে পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মোমেনসহ দুজনকে গ্রেফতার করে থানায় নেয়া হয়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর মোমেন হত্যার কথা স্বীকার করে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কবরস্থানে গিয়ে এবং তার দেখানো স্থান থেকে আবু হুরায়রার মুখ বাঁধা অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :