আজ ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাভিশ্বাস নিম্ন আয়ের মানুষ

রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ের সামনে খোলা আকাশের নিচে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে বসবাস ষাটোর্ধ জমিলা খাতুনের। মা মেয়েতে শাক তুলে ভাগা দিয়ে বিক্রি করে খাবার আর ওষুধের টাকা যোগার করেন জমিলা খাতুন। শাক বেঁচে আগে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা আয় করলেও এখন মেয়ে অসুস্থ থাকায় উপার্জন কমে গিয়েছে তার। সেইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধিতে অল্প আয়ে বেঁচে থাকবার লড়াইয়ের শক্তি হারিরে এখন তিনি নিরুপায়।

মঙ্গলবার (৮ মার্চ) দুপুরে জমিলা খাতুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বাড়িঘর নাই, মরলে মাটি দেওনের জায়গাটাও নাই বাজান। যেনে রাইত সেহানেই কাইত। এই ছালা আর কেথার উপর ঘুমাই, ঝড় বৃষ্টিত কষ্ট অয় খুব অহন আছি শীতের কষ্টে। মায়াডারে লইয়া শাক তুইলা ভাগা দিয়া বেঁচি। মায়াডা ঝিলের পানিতে শাক উটাইতে যাইয়া ব্যাতা পাইছে ওষুধ কিন্না খাওয়াইতাম পারিনা অহন যদি হসপিটালোত যাই কত টেহা কত টেহা।’

শাক বেঁচে জীবন চলে কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যা ইনকাম অয় খাইতেই পারিনা ঠিকমতো, মাইনষের কাছ থেইকা চায়া চিন্তা কোন রকমে চলি। শাকও বাবা নাইক্কা আগের মতো, আজকে পুঞ্চাস টেহা বেঁচছি। সবকিছুর দাম বাড়তি এই কয়ডা টেহা দিয়া কি করমু কও। মায়াডার ওষুধ কিনতে ওইবো হেই চিন্তায় রইছি, আল্লারে কই আল্লা তুমি ভালো করো।

শুধু জমিলা খাতুনই নন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চা বিক্রেতা থেকে শুরু করে রিকশাচালক, মুচি, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ফল বিক্রেতা, গার্মেন্টস কর্মীসহ নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষ সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাকগুলোকে ঘিরে এখন ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষেরাই নয়, সংসার চালাতে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন নিম্নমধ্যবিত্তরাও।

টিসিবির পণ্য কেনা প্রাইভেটকার চালক মো. শহিদুল ইসলামের (৫৫) সঙ্গে বিজয় সরণির মোড়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘কাড়াকাড়ি লাইগ্যা গেছে, ওরে আল্লা মহিলারা সকালে যাইয়া বইয়া থাকে। মাগনা দেয়না পয়সা দিয়া নওয়া লাগে তবু মারামারি। আর কইয়েননা কোনো কোনো পরিবারের ৪/৫ জন আসে কেনার লাইগ্যা, বেশি কইরা কিন্না পরে বিক্রি কইরা ফেলায়। যে খায় এর লাইগ্যা আবার বাড়ে যে খায় না সে পায় না।’

সংসার চলে কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গাড়ি চালায় যা বেতন পাই তাতে ফ্যামিলি নিয়ে চলা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। চাইল, ডাইল, তেল, কাঁচাবাজার সব কিছুর দাম বাড়ছে, তাই মাজেমধ্যে আমিও লাইনে দাঁড়াই। এইযে লাইনে দাঁড়ায়ে ২ কেজি চিনি, ২ কেজি ডাইল আর ২ লিটার তেল কিনলাম, কেউ কেউ ৩টায় আইসা বইয়া রইছে কিন্তু পায়-ই নাই। আট হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়, সংসার খরচ, ছেলে মেয়ে কলেজে পড়ে তার খরচ, এইডা সেইডা আরো কত কি আছে। কথায় আছে না যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ, সামনে আরো কতো কি যে হবে! আমি জমাই মমাই না, যা হয় তাতে খায়েই টিকে থাকা যাচ্ছে না।’

পুলিশপ্লাজায় কথা হলো রিকশাচালক মো. লায়ন ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জমা বাড়ছে মামা, আগে ১০০ টাকা দিয়া রিকশা নিতাম এখন লাগে ১২০ টাকা। কোনোদিন জমে কোনোদিন জমে না। সকাল থেইক্কা সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা চালাইয়া ৫০০/৬০০ টাহা ভাড়া মারি। সাড়ে তিন হাজার টাহা বাসাভাড়া দিতে অয়, চাউল কিনতে অয়, বাজার সদাই করতে অয়, ময়লার বিল, ক্যারেন্ট বিল দিতে অয়, দেশে বাপ মা আছে তাগোরে পাঠাইতে অয়। আমাগো টাকা পয়সা জমে না মামা খরচ হোয়ে যায় , দিনের কামাই দিনেই শেষ। অভাবের তাড়নায় মাইয়ারে গার্মেন্টসে দিছি। আল্লায় যেমনে চালাইবে ওমনেই চলতে হবে মামা।’

করোনা মহামারির কারণে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও বেড়েছে মূ্ল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির কারণে চাল, ডাল,তেল, সবজি, মাংসসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এক সপ্তাহের কম সময়ে তিন দফা বেড়ে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ৭০ টাকায় উঠেছে পেঁয়াজ। খুচরা বাজারের পাশাপাশি পাইকারিতেও পেঁয়াজের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিছুদিন আগে ৩৬-৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এখন পাইকারিতে ৬০-৬২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ৫০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া কাঁচামরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। তেলের দাম বাড়তে বাড়তে হয়েছে ১৬৮ টাকা লিটার।

অস্থিরতা দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের বাজারেও। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, (৬ মার্চ) অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ১১৫ ডলার, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। টনপ্রতি গমের দাম এরই মধ্যে ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলার অতিক্রম করেছে। ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজির মূল (ভ্যাটসহ) এক হাজার ২৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৩৯১ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

একদিকে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি, সেই সঙ্গে নতুন বছরে বাড়ছে বাসাভাড়া। এতে করে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে আছে স্বল্প আয়ের মানুষ। রাজধানীর মালিবাগ থেকে উত্তরাগামী বাসের যাত্রী মিরাজ খান (৩৩) আজ সকালে বলেন, ‘বাস ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ, বাসা ভাড়া বেড়েছে ৫০০ টাকা। বাজার খরচ বেড়েছে, পানি, বিদ্যুৎসহ এমন কিছু নাই যে তার দাম বাড়েনি শুধু আমার বেতনটাই বাড়ে নাই করোনার অজুহাতে।’

বিশেষজ্ঞের মতে, এ আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, মুনাফালোভী মজুতদাররা প্রায়ই অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতায় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, বহির্বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের সংকট ও মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তৃতীয়ত, সরকারি কর্মচারিদের মহার্ঘভাতা বৃদ্ধি। দেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ এরূপ ভাতা পেলেও অসুবিধার দায়ভার বহন করে সমাজের বৃহত্তর অংশ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার বাজার মনিটরিং, কৃষিপণ্যে ভর্তুকি দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট না হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়লেও দুর্নীতিবাজ কর্মচারি ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সুবিধা হচ্ছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় আমাদের উৎপাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এসব ঘটনায় কেউ কেউ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ফায়দা লুটে নিচ্ছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এমন অমানবিক সমস্যায় পীড়িত করে যারা নিজেদের সুখ-সম্পদ আহরণের চেষ্টায় মত্ত, তারা দেশের শত্রু, জনগণের শত্রু ।

এসব অসৎ ও দুর্নীতিবাজ লোকদের উৎখাত এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সরকারের তদারকির পাশাপাশি সাধরণ মানুষের সচেতনতাও জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :