ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ
তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ৪০ দিনের প্রকল্পে গ্রামের অসহায় হতদরিদ্র লোকজনের কাজ করার কথা থাকলেও তা করানো হয়নি। বরং অল্প কয়েকদিন কাজ করে নিজের লোকদের মোবাইল নম্বর দিয়ে সরকারের দেওয়া টাকা চেয়ারম্যান নজরুল হিজড়া ও তার কাছের লোকজন আত্মসাৎ করেছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে গত ১৫ জানুয়ারি ২০২২ থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার অন্তর্গত ২০২১- ২০২২ অর্থ বছরের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।এরই মধ্যে উপজেলার ৬ নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের ৩ টি প্রকল্পের (রাস্তার কাজ) কাজ ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছে। প্রকল্প ৩টি হলো গোপীনাথপুরের পাকা রাস্তা হতে ফজলু বিশ্বাসের বাড়ির পাশের রাস্তা হয়ে আতিয়ারের বাড়ির সামনে পর্যন্ত মাটির কাঁচা রাস্তা সংস্কার। এখানে কাজ করার কথা ছিল ৩০ জন উপকারভোগী, ৩৬ হাজার ঘনফুট মাটি দ্বারা রাস্তাটি সংস্কার করা হবে। আর এর জন্য বরাদ্দ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।ত্রিলোচনপুর পাকা রাস্তা সংলগ্ন ফজলু বিশ্বাসের পাশের রাস্তা হতে নুরো মিয়ার বাড়ির সামনে মাটির কাচা রাস্তা সংস্কার। এখানে কাজ করবেন ৩০ জন উপকারভোগী, মাটির ঘনফুট হবে ৩৬ হাজার এবং বরাদ্দকৃত টাকা হলো ৪ লাখ ৮৮ হাজার। দাতপুর হাফিজুর মন্ডলের বাড়ির সলিং রাস্তার মাথা হতে মুন্তা মন্ডলের বাড়ির সামনে পর্যন্ত মাটির কাঁচা রাস্তা সংস্কার। এখানে কাজ করবেন ৩৩ জন উপকারভোগী, মাটির ঘনফুট হবে ৩৯ হাজার ৬০০টাকা। এই রাস্তার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা হলো ৫ লাখ ২৮ হাজার।দেখা যাচ্ছে, ৩টি প্রকল্পের মোট উপকারভোগীর সংখ্যা হলো ৯৩ জন। মাটির কাজের ঘনফুট হলো ১ লাখ ১১ হাজার ৬০০ জন। মোট বরাদ্দকৃত টাকা হলো ১৪ লাখ ৮৮ হাজার। প্রকল্প ৩টি তে ৯৩ জন উপকারভোগী ৪০ দিন কাজ করবেন। তাদের প্রত্যেকে প্রতিদিন মজুরি হিসেবে ৪০০ টাকা করে পাবেন। তাদের মজুরির টাকা নিজ নিজ মোবাইলে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে দেওয়া হবে। ১৩ মার্চ ৪০ দিনের কর্মসূচির প্রথম কিস্তির টাকা উপকারভোগীর মোবাইল নাম্বারে ঢুকেছে। ৯৩ জন উপকারভোগীর যে মোবাইল নম্বরে টাকা ঢুকেছে তাদের অনেকেই ৪০ দিনের এই কর্মসূচির আওতায় কাজ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন একজন ইউপি সদস্য।আবার প্রকৃতপক্ষে যারা কাজ করেছে তাদের মোবাইল নম্বর উপজেলায় প্রকল্প কর্মকর্তার নিকট জমা দেননি। চেয়ারম্যানের দেওয়া উপকারভোগীদের নামের তালিকা ঠিক আছে কিনা প্রকল্প কর্মকর্তা তা যাচাই-বাছাই করেননি। বরং তিনি ও তার অফিসের ক্যাজুয়াল পিয়ন পিন্টু হোসেন এসব অনিয়মের ব্যাপারে সব জেনেও পদক্ষেপ নেননি।ইউপি সদস্য আরও বলেন, চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু হিজড়া পরিষদের পুরুষ ৯ মেম্বারকে ৫টি করে মোট ৪৫ টি মোবাইল সিম জোগাড় করে তাদের নিজের কাছে রাখতে বলেন। মহিলা মেম্বারদেরকে ৩টি করে ১৫ টি সিম রাখতে বলেন। আর বাকি ৩৩টি মোবাইল সিম চেয়ারম্যান নিজের জন্য রাখেন। শ্রমিকের মজুরির টাকা প্রাপ্তির জন্য উপজেলায় জমা দেওয়া এইসব মোবাইল নম্বরধারীরা হলো চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু ও আনোয়ার মেম্বারের নিকটতম লোকজন।
ত্রিলোচনপুর গ্রামের মৃত মনির উদ্দিন খন্দকারের ছেলে সারোয়ার জানিয়েছেন, মাসখানেক আগে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক আমার বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে ৩ দিন কাজ করে। তারা রাস্তার দুই পাশ সমান করে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে রাস্তায় দেয়। একই সঙ্গে ছোটখাটো গর্ত যেখানে আছে সেই সব গর্ত ভরাটও করেছে। এর থেকে বেশি কোন কিছুই করেনি। বরং অল্প মাটি ফেলাই কাঁদা ও ধুলা হয়ে আমাদের যাতায়াতের অসুবিধাই হয়েছে।একই গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে আজিজুল জানান, মানুষ যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের একজন ব্যক্তিকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে সেই বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তিনি ধরে রাখতে প্রথমেই ব্যর্থ হয়েছেন। তিনটি রাস্তার একটি রাস্তায়ও সঠিকভাবে কাজ করেনি। অবশ্য কাবিখা, কাবিটা ও ৪০ দিনের কর্মসূচি সরকার গ্রামীণ বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য চালু করলেও তার সুফল তারা পায়না।উপজেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিগণ ও ইউপি চেয়ারম্যানরা সিন্ডিকেট করে এই সকল কাজের টাকা আত্মসাৎ করেন। আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একজন হিজড়া সম্প্রদায়ের লোক। ভোটের শুরু থেকেই তিনি মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী আলোচিত সমালোচিত। মুখে খুব ভাল ভাল কথা বললেও চেয়ারম্যানী করতে এসে প্রথম কাজেই তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নিলেন। আসলে যেই বনে যায়, সেই রাবণ হয়।এছাড়াও একই সাথে চলমান ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে ২০২১- ২২ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে গ্রামের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচির নন ওয়েজ একটি প্রকল্পের সভাপতি হলেন ইউপি সদস্য ওসমান আলী। প্রকল্পটিতে গোপীনাথপুর আব্দুল হাইয়ের জমির পাশে একটি ইউড্রেন নির্মাণ এর উল্লেখ রয়েছে। আর এই কাজের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা হলো ৫৪ হাজার ৬১২।প্রকল্পটির সভাপতি ওসমান আলী জানিয়েছেন, আমি যে এই প্রকল্পের সভাপতি আমি নিজেই জানিনা। ইউড্রেন নির্মাণ হয়েছে কিনা আমি বলতে পারিনা। ইউড্রেন কি সেটাও আমি জানি না, কারণ এবার আমি প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছি।সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে কোনো ইউড্রেন আজ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়নি। মহিলা মেম্বার রত্না খাতুন বলেন, আমার ৩টি সিম আমার দেবর জা দের নামে দিয়েছি। আর এক মহিলা মেম্বার লতিফা বেগম বলেন, আমার ৩ টি সিমের মধ্যে ১টি আমার ও ১টি আমার ছেলের নামে দিয়েছি।এব্যাপারে ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু জানিয়েছেন, আমার ইউনিয়নে দেওয়া প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে না হলে আমি আবার করাবো। পুনরায় কাজ করার নিয়ম না থাকলেও নিয়ম বানিয়ে করানো হবে। আমি তো কাজ দেখিনি। মেম্বারদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তারা কিভাবে করেছে আমার জানা নেয়। জানামতে ৩ টি প্রকল্পের কাজই কন্ট্রাক্টে। নিজেদের কিছু লোকদের দিয়ে করানো হয়েছে। কাজে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেয়। আমি ঢাকায় আছি, ফিরে আপনার সঙ্গে দেখা করছি।কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-হেল-আল-মাসুম জানিয়েছেন, বর্তমানে এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ কারণে সব প্রকল্প আমার পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু কিছু প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে কাজের মান ও উপকারভোগীদের উপস্থিতিও ঠিক পেয়েছি। এছাড়াও ইউএনও স্যার নিজে প্রকল্পগুলো তদারকি করেন। স্যার অন্য কর্মকর্তাদেরকেও দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন।আমি কাজের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম ছাড় দিব না। ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে অনিয়ম যদি থেকে থাকে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply