পরামর্শ সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা সাম্প্রতিক বিবেচনায় সর্বোচ্চ। এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতির সব জায়গাতেই পড়বে।
সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিভিন্ন খাতের উৎপাদন খরচ বাড়বে। বিশেষ করে কৃষি, পরিবহন, বিদ্যুৎ, উৎপাদন ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, যা ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসবে।
এতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার মানে ধস নামবে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে সরকারের জ্বালানি তেলের এই ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি কাম্য নয়। এজন্য সরকারকে বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থায় যেতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিভিন্ন খাতের উৎপাদন খরচ বাড়বে। কৃষিখাতে সেচ কাজ ব্যাহত হবে। ফলে খাদ্য উৎপাদন কমবে। এগুলোর ফলশ্রুতিতে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি উঁচু মাত্রায়। গত মাসে কিছুটা কম হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেটা আরও বাড়বে। এতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার মানে ধস নামবে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ানো হলো যে মুহূর্তে ঠিক সেই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নিম্নমুখী। সরকারের সমন্বয় করার প্রয়োজন আছে কিন্তু সময়টা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এছাড়া আমাদের দেশে একটি বিষয় সব সময় কাজ করেÍকোনো জিনিসের দাম একবার বাড়ালে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তখন কমানো হয় না। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে অভ্যন্তরীণ বাজারে যেন দাম কমানো হয়।
জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের ভর্তুকি দেওয়া ঠিক আছে। তা না হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। আর জ্বালানি সরবরাহ করে প্রেট্রোবাংলা কর্পোরেশন। তাই সরকারকে এর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। এটা নিত্যপ্রয়োজনীয় একটা পণ্য, তাই এটা একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব অর্থনীতির সব জায়গাতেই পড়বে। এর প্রভাব বিস্তৃত হবে। ফলে সব জিনিসের দামের ওপর একটা অভিঘাত আনবে, এটা নিশ্চিত। এতে কোনো দ্বিমত নেই। তবে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে সরকার পারতো না। সরকারকে বাধ্য হয়ে বাড়াতে হয়েছে। সরকার অনেক দিন এটা নিয়ে কালক্ষেপণ করেছে। যে কারণে সরকারের ভর্তুকি অনেক বড় হয়ে গেছে। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আর সরকার বেশি দিন এ অবস্থায় চালাতে পারতো না। সব মিলিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্তটা অনেক কঠিন একটা সাহসী সিদ্ধান্ত এবং একটু দেরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগেই এই সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। এখন সরকারের যেটা করণীয় সেটা হলো; সরকারকে জানাতে হবে এ খাতে আর ভর্তুকি আছে কিনা।
তিনি বলেন, ভর্তুকি থাকলে বা না থাকলেও সরকারকে বাজার মূল্যের সাথে দামটাকে সংযোগ করে দিতে হবে। সরকারকে আর দাম ধরে রাখার দরকার নেই, বাজার মূল্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের বাজার মূল্যের সাথে ওঠানামা করবে। কারণ জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কমবে তখন অটোমেটিক দাম কমে যাবে। তা না হলে সরকার বলবে, আমরা ভর্তুকি দিয়েছি, সে জন্য দাম কমাতে পারছি না। আর বাজার মূল্যে ছেড়ে দিলে এটা করার সুযোগ থাকবে। এভাবে করলে ভোক্তারা সরাসরি তখনই লাভবান হয়। অর্থাৎ বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থায় সরকারকে চলে যাওয়া উচিৎ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা সাম্প্রতিক বিবেচনায় সর্বোচ্চ। সেটা সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করছি। মূলত যে খাতগুলোতে ডিজেলের ব্যবহার বেশি হয় যেমন পরিবহন, বিদ্যুৎ ও খাদ্য উৎপাদনে এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, যা ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসবে। পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা সরকারের সাথে আলোচনা করে কী ধরনের মূল্য নির্ধারণ করবে, সেটার ওপর নির্ভর করবে ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে। তবে এই প্রতিক্রিয়া সাথে সাথে পড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি কৃষি খাতে ডিজেলের ব্যবহার সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসলে এর ব্যবহার হয়। সে ক্ষেত্রে এর কৃষি পণ্যের মূল্য বাড়বে।
তিনি বলেন, ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকার কারণে তার প্রতিক্রিয়া এখন না থাকলেও, ব্যক্তি পর্যায়ে ক্যাপটিক পাওয়ারের মাধ্যমে যারা ডিজেল ব্যবহার করছেন, সে ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া থাকবে। অন্যান্য কলকারখানাতে যারা ডিজেল ব্যবহার করছেন সেখানেও এর একটা প্রতিক্রিয়া থাকবে। ফলে সাবগ্রিকভাবে জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেবে। যে কারণে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা হলো দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণের আলোচনার শর্ত হিসেবে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগটি যথাযথ হয়নি। ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় উচিত ছিল যে সমস্ত কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে, বিশেষ করে সরকার বিপিসির যে উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে নেয় সেই অর্থ যদি অর্থ মন্ত্রণালয় না নিতো তাহলে বিপিসি নিজস্ব অর্থেই এই মুহূর্তে ব্যয় মেটাতে পারতো। ভর্তুকি নেওয়া প্রয়োজন হতো না। সুতরাং সরকার যদি বিপিসির উদ্বৃত্ত অর্থ নেওয়া বন্ধ রাখে তা হলে বিপিসি তার নিজের অর্থেই ব্যয় মেটাতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এটির জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি না করলেও চলতো এ সময়ে।
তিনি বলেন, ভোক্তাদের ওপর বিদ্যুতের মূল্য চাপিয়ে না দিয়ে সরকারের উচিত ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ ও ক্যাপাসিটি পেমেন্টের যে জায়গায় ভর্তুকি দিতে হয়, সেখান থেকে সরে আসার জন্য কৌশল খোঁজা। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানের ব্যাপারটি এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
শুক্রবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় শুক্রবার রাত ১২টা থেকেই।।
Leave a Reply