অনলাইন ডেস্ক।
প্রতিবন্ধী। সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে অবহেলিত। প্রতিবন্ধীদের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যথাযথ পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা এবং ব্যবস্থাপনা ছিলো না। সময়ের পরিক্রমায় প্রতিবন্ধীরা এখন নিজেদের ভাগ্য বদলসহ দেশ গঠনে অবদান রাখছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আজ তারা সম্পদে পরিণত হচ্ছে। গত ১১ বছরে সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগে বোঝা থেকে সম্পদে পরিণত হয়েছে প্রতিবন্ধীরা।
প্রতিবন্ধীদের অগ্রযাত্রা আরও ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের সব উপজেলায় প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র স্থাপন করবে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। মোট দুই ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে এই উদ্যোগ। প্রথম ধাপের জন্য ২১১টি উপজেলার নাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করেছে তারা।
মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই শেষে প্লানিং মিনিস্ট্রিতে যাবে এবং একনেকের মাধ্যমে পাস হবে। একইভাবে বাস্তবায়ন করা হবে আরও ২১১টি সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র। বর্তমানে দেশের প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে ১০৩টি সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র রয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় সারা দেশে মোট ৫২৫টি সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যোন্নয়নে শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসেবা নিশ্চিতে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। আর এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রত্যেক প্রতিবন্ধীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ক্রীড়া কমপ্লেক্স করা হচ্ছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অধীনে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স স্থাপনের জন্য সাভার উপজেলাধীন বারইগ্রাম ও দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর মৌজার ১২.০১ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক ৪৪৯ কোটি ৯৬ লাখ ৩২ হাজার টাকার প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে। যা বর্তমানে সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। একই প্রতিবন্ধী ক্রিড়াবিদদের অনুশীলনের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে মাঠ প্রস্তুত করা হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। কর্মের উপযুক্ত প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর আর্থিক, সামাজিক ও ভোকেশনাল পুনর্বাসনের ব্যবস্থা; বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা ও পুরুষ প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আলাদা হোস্টল ব্যবস্থা চালু করা হবে। ফলে প্রত্যেক প্রতিবন্ধী এর থেকে সুবিধা নিতে পারবে।
দেশের সব উপজেলায় প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল করবে সরকার। ইতোমধ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নিজস্ব অর্থায়নে রাজধানীর মিরপুর, লালবাগ, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে একটি করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
একই সাথে ছয়টি বিভাগীয় শহরে (রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর ও সিলেট) এবং গাইবান্ধা জেলায় একটিসহ মোট ১১টি স্কুল চালু করা হয়েছে। ওই স্কুলগুলোতে অটিজম ও এনডিডি সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের অক্ষরজ্ঞান, সংখ্যা, কালার, ম্যাচিং, এডিএল, মিউজিক, খেলাধুলা, সাধারণ জ্ঞান, যোগাযোগ, সামাজিকতা, আচরণ পরিবর্তন এবং পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এসব স্কুলে প্রতি শিক্ষাবর্ষে গড়ে ২০০ জন অটিজম সমস্যাগ্রস্ত শিশু বিনামূল্যে লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য শুধু আগামী দিনের জন্য পরিকল্পনাই করা হয়নি। বর্তমান সরকারের সময়েই প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে থেরাপিউটিক সেবা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সময়কালে দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
কেন্দ্রের মাধ্যমে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত সেবাগ্রহীতার সংখ্যা পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৪২৯ জন ও মোট প্রদত্ত সেবা সংখ্যা ৬৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫২৮টি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আশার পর ২০১০ সালে এই প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন থেকেই প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক সেবা দেয়া হচ্ছে।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেক েপ্রতি বছর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন, হুইল চেয়ার, ট্রাইসাইকেল, ক্র্যাচ স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, ওয়াকিং ফ্রেম, সাদাছড়ি, এলবো ক্র্যাচ, শ্রবণ যন্ত্রসহ প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সামগ্রী বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৪৫ হাজার ৫৩৪টি সহায়ক উপকরণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অটিজমসহ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য মোবাইল থেরাপি ভ্যানের মাধ্যমে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক সেবা দেয়া হচ্ছে। ২০১৫ সালে এ কার্যক্রম উদ্বোধনের সময় থেকে ৩২টি মোবাইল থেরাপি ভ্যানের মাধ্যমে সাত লাখ ৯০ হাজার ৮৬৬ জনকে বিনামূল্যে নিবন্ধিত থেরাপিউটিক সেবা দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে ২০১০ সালে একটি অটিজম রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ওই সেন্টার থেকে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিকে বিনামূল্যে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের থেরাপি সেবা, গ্রুপ থেরাপি, দৈনন্দিন কার্যবিধি প্রশিক্ষণসহ রেফারেল ও অটিজম সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের মা-বাবাদের কাউন্সেলিং সেবা দেয়া হচ্ছে।
২০১০ সালে চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ২২৪ জন অটিজম সমস্যাগ্রস্ত শিশু ও ব্যক্তি এবং অভিভাবককে বিনামূল্যে ম্যানুয়াল থেরাপি সার্ভিস সেবা দেয়া হয়েছে।
প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে ফাউন্ডেশন চত্বরে পাঁচ দিনব্যাপী প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় প্রতিভাবান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা গান, নাটক ও কবিতা আবৃতিতে অংশগ্রহণ করে। মেলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তৈরিকৃত বিভিন্ন খাবার সামগ্রী, নকশিকাঁথা, তৈরি পোশাক, শাড়ি, খেলনা সামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, মুক্তাপানি, বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়।
এছাড়া, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার প্রতিবন্ধী উপকৃত হয়। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ২০১৬ সালে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ও ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে ৪১ জন এবং ২০১৮ সালে ১০৫ জন প্রতিবন্ধীকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি দেয়া হয়।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধাক্কার প্রভাব সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের ওপর পড়েছে। আর করোনায় সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েন প্রতিবন্ধীরা। সরকারের নির্দেশনায় করোনাকালীন সময়ে এই সকল প্রতিবন্ধীদের পাশে ছিলো জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। তারা প্রতিটি প্রতিবন্ধীদের বাড়ি বাড়ি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে।
এছাড়াও করোনাকালীন সময়ে প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের নিজস্ব অর্থায়নে এক কোটি ২২ লাখ টাকা জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে বিতরণ করেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের জন্য ২০০৩-০৪ থেকে ফাউন্ডেশনের কল্যাণ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ কোটি টাকা অনুদান ও ঋণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সারা দেশে অনুদান ও ঋণের মাধ্যমে উপকারভোগী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিছুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশে অনেক প্রতিবন্ধী রয়েছে। যারা সমাজে এখনো অবহেলিত। কিন্তু সরকারর প্রতিবন্ধীদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যে সকল উদ্যোগ দরকার তা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করছে। দেশের একজন প্রতিবন্ধীও অবহেলিত থাকবে না। সরকারের সকল উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রতিটি ইউনিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করে যাচ্ছেন।’
দেশের প্রতিটি উপজেলাতে পর্যায়ক্রমে প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র স্থাপন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সরকারপ্রধানের সেই নির্দেশনা দুই ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।
সেই লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের একটা নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ২১১টি উপজেলায় দুই ধাপে কেন্দ্র স্থাপন করবো। এ জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেটা মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই শেষে প্লানিং মিনিস্ট্রিতে যাবে এবং একনেকের মাধ্যমে পাস হবে।
Leave a Reply