আজ ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৪ বছর ধরে ডুগডুগি ও শিয়ালমারি পশুহাট আওয়ামী লীগের নেতার পর এবার হাট দুটির দখল নিল বিএনপি নেতারা:শত কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার

টানা ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে ছিল চুয়াডাঙ্গার সবথেকে বড় দুটি পশুহাট। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছরে টেন্ডার হওয়ার কথা থাকলেও তা একবারও হয়নি। কৌশলে উচ্চ আদালতে করা একটি রিটের বলে বছরের পর বছর রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রভাবশালী ওই মহলটি। এতে প্রায় শত কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। চলমান খাস বন্দোবস্তের পাশাপাশি হাট উদ্ধারে সমাধানের পথ খুঁজছে স্থানীয় প্রশাসন। এখন মৌখিক বন্দোবস্তে হাট দুটি পরিচালনায় রয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পার্থক্য শুধু প্রতি হাটে খাস কালেকশন করে আওয়ামী লীগ দিতো ২ লাখ, আর এখন বিএনপি দিচ্ছে ৫ লাখ।

চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের অঞ্চলের মধ্যে সবথেকে বড় পশুহাট দামুড়হুদার ডুগডুগি ও জীবননগরের শিয়ালমারী। সপ্তাহের হাটবারে এই দুটি হাটে লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকা। কোরবানি ঈদের আগে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় কোটির ঘরে। অথচ আইনের মারপ্যাঁচ ও কাগজ জালিয়াতির মাধ্যমে হাটের ডাক হয়নি টানা ১৪ বছর। অভিযোগ, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগর টগর ও তার লোকজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল হাট দুটি। সে সময় হাট দখলে রাখা নেতাদের পকেট ভারি হলেও রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। আর এখন হাট দুটি দখল নিয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতারা।

অন্য ইজারাদারদের দাবি, ২০১০ সালেই এ দুটি হাটের দর উঠেছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা। কিন্তু তখন থেকেই আর দরপত্র আহ্বান ছিল বন্ধ। এতদিনে প্রায় শতকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আওয়ামীপন্থি ইজারাদাররা আদালতকে প্রভাবিত করে হাট কুক্ষিগত করে রেখেছে। ১৭ বছর আগে শিয়ালমারী ও ডুগডুগি হাটের ডাকে ইজারা পেয়েছিলেন এমপি টগরের ঘনিষ্ঠ সহচর আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব হোসেন ও ফরহাদ হোসেন। নির্ধারিত সময় শেষ হলে তারা হাইকোর্টে লোকশান হয়েছে জানিয়ে কিছুদিন সময় চেয়ে রিট করেন। রিটে ৬ মাস অতিরিক্ত সময় পান ইজারাদাররা। রিটের পর স্থগিতাদেশ এবং শুরু হয় খাস কালেকশন। খাস কালেকশনের নিয়মেই এতো বছর চলছে। এমপি টগর প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর রিট করে মেয়াদ বাড়িয়ে চলেছেন।

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, খাস বন্দোবস্তে দীর্ঘদিন হাট চালানো কঠিন। আইনি প্রক্রিয়ায় হাটের বৈধতা ফিরিয়ে আনতে সমাধানের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে হাট দুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বিএনপি নেতারা। প্রতি হাটে শিয়ালমারীর জন্য ৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ও ডুগডুগির জন্য ৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা সরকারকে রাজস্ব দেয়া হচ্ছে। বছরে ৫২টি করে দুটি হাটে মোট ১০৪টি হাট বসে।

জীবননগর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, সবাই মিলে হাট দুটি পরিচালনা করা হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর টগর মিয়া বিএনপির লোকজনদের একেবারে বাদ দিয়ে দিলো। ১৪ বছরে এই দুটি হাটে কত টাকা লোকসান হয়েছে, ক্যাকুলেটরে ধরবে না। আগে তারা মাত্র ২ লাখ টাকা করে দিতো। এখন আমরা ৫ লাখ টাকা দিচ্ছি। বছরে ৫২টি হাট। ২০১০ সালে ডুগডুগি হাটের ডাক হয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও শিয়ালমারি হাটের ডাক হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। তখন যদি এতো টাকা থাকে, তাহলে এখন কত হতে পারে। টাকার মূল্যমানও যদি হিসেব করা হয়, তাহলে বোঝেন।
তিনি আরও বলেন, ‘৩০ বছর আমরা ইজারাদার হিসেবে হাট চালাতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর আমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ আসার পর ১৭ বছর ৮ মাস হয়ে গেল এই হাটের কোনো ডাক হয়নি। আমি মনে করি, যদি চুয়াডাঙ্গার হাটগুলোর ইজারা ঠিক হয়, তাহলে চুয়াডাঙ্গার অন্য কিছু লাগে না। বিপুল পরিমাণে রাজস্ব এখান থেকেই আসবে। হাটটি পড়েই ছিল, আমরা প্রশাসনকে বলেছিলাম। আপাতত সরকারের রাজস্ব দেয়ার শর্তে মৌখিকভাবে হাটটি আমরা চালাচ্ছি।’

দামুড়হুদা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, স্বৈরাচারী হাসিনার পালানোর পর হাট দুটো পড়েছিল। এমনিতে সরকার ১৭ বছর বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছিল। তাই হাটের সাথে পূর্বেও যারা ছিল, তারাই পুনরায় হাটটি চালাচ্ছে। খাস কালেকশন করে প্রতি হাটে ৫ লাখ টাকা রাজস্ব জমা দেয়া হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড. কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, চুয়াডাঙ্গার কেবল দুটি হাট নয়। আরও কয়েকটি হাট বাজার নিয়ে মামলা চলমান আছে। সরকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং বিজ্ঞ আদালত থেকে যে জবাব চাওয়া হয়েছে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেই জবাব আমরা পাঠিয়ে দিয়েছে। মামলা চলমান থাকার কারণে স্টে অর্ডার (স্থগিতাদেশ) দেয়া আছে। বিজ্ঞ আদালতে এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত টেন্ডার বা ইজারা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের যে বিধান, কোনো কারণে যদি ইজারা দেয়া সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে খাস কালেকশনের বিধান আছে। জেলা পর্যায়ের একটি কমিটি আছে। দীর্ঘদিন ধরে এই খাস কালেকশন কার্যক্রম চালানো একটু চ্যালেঞ্জিং বিষয়। স্থানীয় পক্ষ-বিপক্ষ নানা ধরনের গ্রুপিং তৈরি হয়। এটি যদি নিয়মিত ইজারার মধ্যে আনা যায়, তাহলে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া সম্ভব। এখন আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালতকে জানাচ্ছি, সরকারের স্বার্থে এটির আশু নিষ্পত্তি প্রয়োজন। যখনি যে জবাব, যে কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে, আমরা তা পাঠিয়েছি। আমরা আশাবাদী যতদ্রুত এই মামলাগুলো আদালতে নিষ্পত্তি হবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বিপুল রাজস্বের পাশাপাশি স্থানীয় বিবাদ কমে যাবে।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :