রাজস্ব আহরণে ঘাটতি বাড়ছেই

রাজস্ব আহরণে ঘাটতি বেড়েই চলছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাস (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। সাম্প্রতিক সময়ে এ অনুপাত আরও কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর কর-জিডিপি অনুপাত ১৯ শতাংশেরও বেশি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন কৌশল হাতে নিয়েছে সরকার।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ সামর্থ্যরে অর্ধেকেরও কম। রাজস্ব আহরণ কাক্সিক্ষত মাত্রায় না এগোনোর ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবপুঁজি গঠন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, রাজস্ব আহরণ না বাড়ার কারণ প্রথমত, কর আহরণে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত, ফলে পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, করদাতাদের আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব বড় এক বাধা। কারণ অনেকেই মনে করেন, তাদের পরিশোধিত কর যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। তৃতীয়ত, কর আদায়ে দুর্নীতি এবং কার্যকর পদ্ধতির অভাব প্রক্রিয়াটি আরও জটিল করেছে। পাশাপাশি করের আওতায় আসা উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা খুবই কম, যা রাজস্ব সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি করছে। ভ্যাট ও শুল্কের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্সের তুলনায়, কর জিডিপি কম হওয়ার একটি বড় কারণ, যা সুষম রাজস্ব প্রবাহের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা, তবে আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। সেই তুলনায় চলতি বছরে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের মাঝপথে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়।
গবেষণা ও পরিসংখ্যানের হিসাব
অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা; গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৬৫ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায় কমেছে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ কম।
স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট বা মূসক ও আবগারি শুল্ক খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২ দশমিক ২১ শতাংশ। অন্যদিকে আয়কর ও ভ্রমণ খাতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ৭৩ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা; যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৭০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এ হিসাবে আদায় বেড়েছে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র?্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। ফলে সংকুচিত হচ্ছে অর্থনীতি। রাজস্ব আদায়ের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ উন্নয়ন খাতের নানান ইস্যুতে চাপ বাড়ে। বাজেট কমাতে হয়। তিনি বলেন, সেবা পেলে মানুষ কর দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিভিন্ন খাতের সরকারি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এটা পরিবর্তন করে প্রত্যক্ষ কর অন্তত ৬৫ শতাংশ করা উচিত। কর প্রদানের পদ্ধতিগত জটিলতা দূর করতে হবে। বাজেটে ঘাটতি কমাতে হবে। দেশের আর্থিক উন্নতি, পরনির্ভরশীলতা কমানো ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে দেশের ভেতরে কর আহরণ বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক; কিন্তু কর আহরণ ও কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে অবকাঠামো সমস্যার কারণে দেশের কর-জিডিপি হার এখনও অনেক কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও অনেক কম। রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট আদায়ের আওতা বাড়ানোর কাজ করছে এনবিআর। অতীতে ট্যাক্স আদায়ে পলিসি লেভেলে জোর দেওয়া হলেও বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমকে অটোমেশন করতে উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এটি বাস্তবায়ন হলে ট্যাক্স নিয়ে বর্তমানে যে ভীতি রয়েছে সেটা কমবে। ভবিষ্যতে আর অফলাইনে রিটার্ন নেওয়া হবে না। যারা ট্যাক্স ফাঁকি দেন, তাদের তদারকির আওতায় আনা হবে এবং যারা ট্যাক্স দেন তারা হয়রানির শিকার হবেন না।