চুয়াডাঙ্গা ০৯:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পরোয়ানা থাকা ১৫ কর্মকর্তা সেনা হেফাজতে

Padma Sangbad

অনলাইন ডেস্ক।।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চার্জশিটে নাম আসা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৫ জনকে ঢাকায় সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন কর্মরত এবং একজন এলপিআরে থাকা কর্মকর্তা। কর্মরতদের একজন নোটিশ করার পরও সাড়া দেননি। তিনি যেন চলে যেতে না পারেন, সেটি মাথায় নিয়ে খোঁজ রেখেছি। গতকাল শনিবার বিকালে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বুধবার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মামলায় আসামি ১৭ জন এবং জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের মামলায় ১৩ জন। দুই মামলাতেই প্রধান আসামি করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তৎকালে তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত

মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালকের নাম রয়েছে আসামির তালিকায়। দুই মামলার ৩০ আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। চার্জশিটে নাম আসা ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও চায় গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঠিক বিচার হোক। সেনাবাহিনী ইনসাফ চায়। ন্যায়বিচার বা ইনসাফের প্রশ্নে সেনাবাহিনী আপসহীন। তবে অফিসিয়ালি এখনও চার্জশিটের কপি সেনাবাহিনী হাতে পায়নি। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য থেকেই এসব কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। যদিও নোটিশ দেওয়ার পরও মেজর জেনারেল কবীর (কবীর আহম্মদ) নামে এক সেনা কর্মকর্তা সাড়া দেননি। তার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে চার্জশিটের কপি পেলে কার কী অপরাধ তা আমরা খতিয়ে দেখব। পাশাপাশি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে আমরা তাদের কাছ থেকে মতামত বা বক্তব্য চাইব।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, গত ৮ অক্টোবর আইসিটিতে প্রথম দুটি চার্জশিট জমা পড়ে। এরপর তৃতীয় আরেকটা চার্জশিট জমা পড়ে। এ সংবাদ আসা শুরু করেছে সেদিন বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে। আমরা টিভি স্ক্রলের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, চার্জশিট জমা পড়েছে এবং ট্রাইব্যুনালে গৃহীত হয়েছে। চার্জশিটগুলোর মধ্যে একটা ছিল গুমসংক্রান্ত, যারা তখন ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন। তাদের একটা বড় অংশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। আরেকটা ছিল র?্যাবের টিএফআই নিয়ে এবং আরও একটা ছিল ৪-৫ আগস্টের (২০২৪ সালের) রামপুরার ঘটনা নিয়ে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর আইজিপির কাছে চলে যায় নিয়ম অনুযায়ী এবং ২২ তারিখ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা এ পর্যন্ত কোনো চার্জশিট কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি। তিনি বলেন, চার্জশিটে ২৫ সেনা কর্মকর্তার নাম এসেছে। এর মধ্যে অবসরে আছেন ৯ কর্মকর্তা, এলপিআরে একজন এবং কর্মরত আছেন ১৫ জন। যারা অবসরে চলে গেছেন তাদের প্রতি আমাদের সেনা আইন সেভাবে খাটে না।

সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সকল আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ তারিখে কর্মরত ১৪ ও এলপিআরে থাকা একজন সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে আনার জন্য একটা আদেশ সংযুক্তি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আদেশে তাদের বলা হয়েছে, ৯ তারিখে তারা যেন ঢাকা সেনানিবাসে সেনা হেফাজতে চলে আসেন। আমরা কিন্তু এখনও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি বা পুলিশও আমাদের কিছু জানায়নি। এর পরও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব কর্মকর্তাকে হেফাজতে আসার জন্য আদেশ দেয়।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ রকম প্র্যাকটিস করে। এটার মতো না হলেও এ রকম কিংবা অনেক সেনসিটিভ কেসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫৪ বছর পার করে এসেছে। যাদের নামে অভিযোগ ওঠে প্রথমে তাদের আমরা হেফাজতে নিয়ে নিই। তখন কোর্ট মার্শাল হয়। কোর্ট মার্শালের রায় অনুযায়ী, বিচারের রায় অনুযায়ী তখন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমরা যাদের হেফাজতে আসতে বলেছি, তাদের মধ্যে সবাই রেসপন্স করেছে। শুধু একজন কর্মকর্তা ৯ তারিখ পর্যন্ত কোনো রেসপন্স করেননি। পরে ১০ তারিখে আমরা তার সঙ্গে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করি এবং তার পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। আমরা জানতে পারি, উনি ৯ অক্টোবর সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে। পরে আর বাসায় ফেরেননি। এরপর তার সঙ্গে তার পরিবারেরও মোবাইল ফোনে আর কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি। তিনি হলেন মেজর জেনারেল কবির। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ম অনুযায়ী তাকে আমরা ইলিগ্যাল অ্যাবসেন্ট হিসেবে ঘোষণা করি। এরপর এ বিষয়ে আমরা আরও কিছু অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করি। পাশাপাশি ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবিকে আমরা বলেছি যেন স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে উনি অবৈধভাবে দেশের বাইরে যেতে না পারেন। ওনার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনাতেও আমরা লোক পাঠিয়েছি। উনি দেশের বাইরে চলে যেতে পারেন, এটিও মাথায় রেখে আমরা খোঁজ নিয়েছি।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, যারা গুম হয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের সকলের সমাবেদনা ও দোয়া আছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর চাকরির সঙ্গে সিভিল চাকরির পার্থক্য আছে। এখন আমাদের মেজরের চাকরির বয়স ৫০ বছর। এখন ধরে নিচ্ছি, আমাদের একজন মেজরের বয়স ৪৯ বছর ৭ মাস। তার বিচার শেষ হতে হতে তার বয়স ৫০ পার হয়ে গেল। এরপর বলা হলো, তিনি নির্দোষ। কিন্তু তখন তিনি অবসরে চলে গেছেন। তাকে তো আবার বাহিনীতে নেওয়া যাবে না। বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী হলে তার বিচার হবে। কিন্তু খালাস হয়ে গেলে তার ব্যাপারে আমরা কী করব? চাকরিতে তো ফেরাতে পারব না। তিনি আরও বলেন, এখন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এসব বিষয়ে আইন অনুযায়ী সাধারণত একটি ব্যাখ্যা কিংবা নোট দেওয়া হয়। আমরা একটা ব্যাখ্যা চাইব।

গুম কমিশনের ব্যাপারে এই মেজর জেনারেল বলেন, আমরা কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি। কমিশন যেসব ডকুমেন্ট চেয়েছে, আমরা সহযোগিতা করেছি। গত বৃহস্পতিবারও আমরা কমিশনকে ডকুমেন্ট দিয়েছি।

চার্জশিটে নাম আসা কর্মকর্তাদের বিষয়ে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা র‌্যাবে কিংবা ডিজিএফআইয়ে ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে র‌্যাব, আর্মির অধীনে নয়। র‌্যাব আর্মি হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ডিজিএফআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে কাজ করে। তারা তাদের সিস্টেমে কাজ করে। এখন, কে কতটুকু জড়িত ছিলেন, তা চার্জশিটসহ বিস্তারিত এলে জানা যাবে।

আগামী ২২ অক্টোবর আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, আইনগতভাবে যা হওয়া উচিত, আমরা তা-ই করব। আমাদের কিছু আইনগত ব্যাখ্যা দরকার আছে। সেটা পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেব।

নির্বাচনের বিষয়ে মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সংখ্যা তিন-চারগুণ বাড়ানো হবে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেশের জন্য যেটা ভালো হবে, সেটা আমরা জীবন দিয়ে হলেও করব। জাতি অপেক্ষা করছে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। আমরা চেষ্টা করব সেভাবেই নির্বাচনে সহযোগিতা করার।

অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়ে মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, পুলিশ যদি গ্রেপ্তার করতে চায়, করতে পারে। আমরা বলেছি, তারা যাদি আমাদের হেফাজতে আসতে চান, আসতে পারেন।

চাঞ্চল্যকর তনু হত্যার বিষয়ে এই মেজর জেনারেল বলেন, তনু হত্যার বিচার সেনা আইনে হচ্ছে না। মামলা আছে সিভিল আদালতে। পুলিশ সেখানে কাজ করছে। পুলিশ যদি সেনাবাহিনীর কাছে সাহায্য সহযোগিতা কিংবা ডকুমেন্ট চায় সেনাবাহিনী অবশ্যই সেটা দেবে।

ট্রাইব্যুনালে দুই মামলায় চার্জশিটভুক্ত এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরতরা হলেন- মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, কর্নেল কে এম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন।

আপডেট : ০৬:৩০:৩৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

পরোয়ানা থাকা ১৫ কর্মকর্তা সেনা হেফাজতে

আপডেট : ০৬:৩০:৩৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

অনলাইন ডেস্ক।।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চার্জশিটে নাম আসা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৫ জনকে ঢাকায় সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন কর্মরত এবং একজন এলপিআরে থাকা কর্মকর্তা। কর্মরতদের একজন নোটিশ করার পরও সাড়া দেননি। তিনি যেন চলে যেতে না পারেন, সেটি মাথায় নিয়ে খোঁজ রেখেছি। গতকাল শনিবার বিকালে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বুধবার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মামলায় আসামি ১৭ জন এবং জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের মামলায় ১৩ জন। দুই মামলাতেই প্রধান আসামি করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তৎকালে তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত

মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ মহাপরিচালকের নাম রয়েছে আসামির তালিকায়। দুই মামলার ৩০ আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। চার্জশিটে নাম আসা ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও চায় গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঠিক বিচার হোক। সেনাবাহিনী ইনসাফ চায়। ন্যায়বিচার বা ইনসাফের প্রশ্নে সেনাবাহিনী আপসহীন। তবে অফিসিয়ালি এখনও চার্জশিটের কপি সেনাবাহিনী হাতে পায়নি। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য থেকেই এসব কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। যদিও নোটিশ দেওয়ার পরও মেজর জেনারেল কবীর (কবীর আহম্মদ) নামে এক সেনা কর্মকর্তা সাড়া দেননি। তার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে চার্জশিটের কপি পেলে কার কী অপরাধ তা আমরা খতিয়ে দেখব। পাশাপাশি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারপ্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে আমরা তাদের কাছ থেকে মতামত বা বক্তব্য চাইব।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, গত ৮ অক্টোবর আইসিটিতে প্রথম দুটি চার্জশিট জমা পড়ে। এরপর তৃতীয় আরেকটা চার্জশিট জমা পড়ে। এ সংবাদ আসা শুরু করেছে সেদিন বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে। আমরা টিভি স্ক্রলের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, চার্জশিট জমা পড়েছে এবং ট্রাইব্যুনালে গৃহীত হয়েছে। চার্জশিটগুলোর মধ্যে একটা ছিল গুমসংক্রান্ত, যারা তখন ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন। তাদের একটা বড় অংশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। আরেকটা ছিল র?্যাবের টিএফআই নিয়ে এবং আরও একটা ছিল ৪-৫ আগস্টের (২০২৪ সালের) রামপুরার ঘটনা নিয়ে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর আইজিপির কাছে চলে যায় নিয়ম অনুযায়ী এবং ২২ তারিখ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা এ পর্যন্ত কোনো চার্জশিট কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি। তিনি বলেন, চার্জশিটে ২৫ সেনা কর্মকর্তার নাম এসেছে। এর মধ্যে অবসরে আছেন ৯ কর্মকর্তা, এলপিআরে একজন এবং কর্মরত আছেন ১৫ জন। যারা অবসরে চলে গেছেন তাদের প্রতি আমাদের সেনা আইন সেভাবে খাটে না।

সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সকল আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ তারিখে কর্মরত ১৪ ও এলপিআরে থাকা একজন সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে আনার জন্য একটা আদেশ সংযুক্তি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আদেশে তাদের বলা হয়েছে, ৯ তারিখে তারা যেন ঢাকা সেনানিবাসে সেনা হেফাজতে চলে আসেন। আমরা কিন্তু এখনও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি বা পুলিশও আমাদের কিছু জানায়নি। এর পরও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব কর্মকর্তাকে হেফাজতে আসার জন্য আদেশ দেয়।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ রকম প্র্যাকটিস করে। এটার মতো না হলেও এ রকম কিংবা অনেক সেনসিটিভ কেসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫৪ বছর পার করে এসেছে। যাদের নামে অভিযোগ ওঠে প্রথমে তাদের আমরা হেফাজতে নিয়ে নিই। তখন কোর্ট মার্শাল হয়। কোর্ট মার্শালের রায় অনুযায়ী, বিচারের রায় অনুযায়ী তখন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমরা যাদের হেফাজতে আসতে বলেছি, তাদের মধ্যে সবাই রেসপন্স করেছে। শুধু একজন কর্মকর্তা ৯ তারিখ পর্যন্ত কোনো রেসপন্স করেননি। পরে ১০ তারিখে আমরা তার সঙ্গে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করি এবং তার পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। আমরা জানতে পারি, উনি ৯ অক্টোবর সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে। পরে আর বাসায় ফেরেননি। এরপর তার সঙ্গে তার পরিবারেরও মোবাইল ফোনে আর কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি। তিনি হলেন মেজর জেনারেল কবির। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ম অনুযায়ী তাকে আমরা ইলিগ্যাল অ্যাবসেন্ট হিসেবে ঘোষণা করি। এরপর এ বিষয়ে আমরা আরও কিছু অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করি। পাশাপাশি ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবিকে আমরা বলেছি যেন স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে উনি অবৈধভাবে দেশের বাইরে যেতে না পারেন। ওনার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনাতেও আমরা লোক পাঠিয়েছি। উনি দেশের বাইরে চলে যেতে পারেন, এটিও মাথায় রেখে আমরা খোঁজ নিয়েছি।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, যারা গুম হয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের সকলের সমাবেদনা ও দোয়া আছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর চাকরির সঙ্গে সিভিল চাকরির পার্থক্য আছে। এখন আমাদের মেজরের চাকরির বয়স ৫০ বছর। এখন ধরে নিচ্ছি, আমাদের একজন মেজরের বয়স ৪৯ বছর ৭ মাস। তার বিচার শেষ হতে হতে তার বয়স ৫০ পার হয়ে গেল। এরপর বলা হলো, তিনি নির্দোষ। কিন্তু তখন তিনি অবসরে চলে গেছেন। তাকে তো আবার বাহিনীতে নেওয়া যাবে না। বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী হলে তার বিচার হবে। কিন্তু খালাস হয়ে গেলে তার ব্যাপারে আমরা কী করব? চাকরিতে তো ফেরাতে পারব না। তিনি আরও বলেন, এখন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এসব বিষয়ে আইন অনুযায়ী সাধারণত একটি ব্যাখ্যা কিংবা নোট দেওয়া হয়। আমরা একটা ব্যাখ্যা চাইব।

গুম কমিশনের ব্যাপারে এই মেজর জেনারেল বলেন, আমরা কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি। কমিশন যেসব ডকুমেন্ট চেয়েছে, আমরা সহযোগিতা করেছি। গত বৃহস্পতিবারও আমরা কমিশনকে ডকুমেন্ট দিয়েছি।

চার্জশিটে নাম আসা কর্মকর্তাদের বিষয়ে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা র‌্যাবে কিংবা ডিজিএফআইয়ে ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে র‌্যাব, আর্মির অধীনে নয়। র‌্যাব আর্মি হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ডিজিএফআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে কাজ করে। তারা তাদের সিস্টেমে কাজ করে। এখন, কে কতটুকু জড়িত ছিলেন, তা চার্জশিটসহ বিস্তারিত এলে জানা যাবে।

আগামী ২২ অক্টোবর আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, আইনগতভাবে যা হওয়া উচিত, আমরা তা-ই করব। আমাদের কিছু আইনগত ব্যাখ্যা দরকার আছে। সেটা পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেব।

নির্বাচনের বিষয়ে মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সংখ্যা তিন-চারগুণ বাড়ানো হবে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেশের জন্য যেটা ভালো হবে, সেটা আমরা জীবন দিয়ে হলেও করব। জাতি অপেক্ষা করছে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। আমরা চেষ্টা করব সেভাবেই নির্বাচনে সহযোগিতা করার।

অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়ে মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, পুলিশ যদি গ্রেপ্তার করতে চায়, করতে পারে। আমরা বলেছি, তারা যাদি আমাদের হেফাজতে আসতে চান, আসতে পারেন।

চাঞ্চল্যকর তনু হত্যার বিষয়ে এই মেজর জেনারেল বলেন, তনু হত্যার বিচার সেনা আইনে হচ্ছে না। মামলা আছে সিভিল আদালতে। পুলিশ সেখানে কাজ করছে। পুলিশ যদি সেনাবাহিনীর কাছে সাহায্য সহযোগিতা কিংবা ডকুমেন্ট চায় সেনাবাহিনী অবশ্যই সেটা দেবে।

ট্রাইব্যুনালে দুই মামলায় চার্জশিটভুক্ত এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরতরা হলেন- মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, কর্নেল কে এম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন।