অনলাইন ডেস্ক।।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে অটোরিকশার ধাক্কায় তিনজন মারা গেছেন। এর কারণ অনুসন্ধানে মঙ্গলবার সকালে আখাউড়া পৌর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেওয়ার মাঝেই জানা যায় আরো দুটি দুর্ঘটনার খবর। উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের সামনে অটোর ধাক্কায় গুরুতর আহত উপজেলার টানমান্দাইল গ্রামের সাহেদ মিয়া (৭০) নামে এক বৃদ্ধকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়েছে। রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে হওয়া দুর্ঘটনায় অবশ্য কেউ তেমন আহত হননি।
বেলা সোয়া পাঁচটার দিকে আখাউড়া পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু কাউছার ভূঁইয়া এ প্রতিবেদককে ফোন করে জানান, সড়ক বাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি মোটরসাইকেলকে অহেতুক ধাক্কা দিয়ে ফেল দেয় অটোরিকশা। আর ওই অটোরিকশার চালক এক শিশু। এ বিষয়ে পত্রিকায় লেখালেখির জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
সাড়ে পাঁচটায় রাধানগর বনিক পাড়ার বাসিন্দা রঞ্জিত কাহার জানান, সড়ক বাজারে অটোর ধাক্কায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চান্দি গ্রামের বজলু মিয়ার ছেলে রৌশন মিয়া (৪৫) আহত হন। তিনি আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেন। সরজমিনে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনা আখাউড়াতে এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। এমন কোনো দিন নেই যে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে না অটোরিকশাগুলো। কচি আর কাঁচা হাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার স্টিয়ারিং। ১২-১৪ বছর বয়সি শিশুরাও চালাচ্ছে অটোরিকশা। বড়রা যারা চালাচ্ছেন তাঁদেরও নেই কোনো প্রশিক্ষণ। প্রবাস ফেরত কিংবা বেকার যে কেউ অটোরিকশা কিনে বা ভাড়া নিয়ে নেমে পড়ছেন সড়কে। গত কয়েকদিনের টানা দুর্ঘটনার কারণে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো যেন আখাউড়াতে এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন এলাকার মানুষ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১২ ডিসেম্বর পৌর এলাকার রাধানগরে বাড়ির সামনে মাছ কিনে রাস্তা পারাপারের সময় অটোরিকশা চাপায় আহত হন ওই এলাকার প্রদীপ সাহার স্ত্রী বিজলী রানী সাহা (৬২)। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে তিনি মারা যান। বিজলী রানীকে ধাক্কা দেয়া অটোরিকশা চালক মো. শওকত মূলত হোটেল শ্রমিক। মাত্র আট-১০ দিন ধরে তিনি অটোরিকশা চালাচ্ছিলেন। বিজলী রানীকে অনেক দূর থেকে দেখে হর্ণ বাজালেও থামানোর বিষয়টি চিন্তা করেননি শওকত।
এদিকে সোমবার পৃথক সড়ক দূর্ঘটনায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তারা হলেন, মো. ইলিয়াস চৌধুরী (৪৫) ও মোহন মিয়া (৭০)। নারায়ণপুর বাইপাস এলাকায় নিহত ইলিয়াস চৌধুরী উপজেলার নূরপুর গ্রামের বশির চৌধুরীর ছেলে। এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মোটরসাইকেল ঘুরানোর সময় আরেকটিকে ওভারটেক করে এসে দ্রুত গতির অটোরিকশা মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। অটোরিকশার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে স্পষ্টতই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়।
রাধানগর হাজি মহল্লার মসজিদের সামনে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সোয়াগাজী ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের নাবালক মিয়ার ছেলে মোহন মিয়া সড়কে পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় অটোরিকশা ধাক্কা দেয়। প্রথমে আখাউড়া ও পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল থেকে ঢাকায় নেয়ার পথে তিনি মারা যান। তাবলীগ জামায়াতে অংশ নিতে মোহন মিয়া আখাউড়ায় এসছিলেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর নাগাদ রাধানগর চৌরাস্তা মোড়, ঘোষপাড়া মোড়, সড়ক বাজার, উপজেলা পরিষদ এলাকা, বাইপাস এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, এলাকায় চলা যানবাহনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাই বেশি। এক হাজারেরও বেশি অটোরিকশা পৌর এলাকায় চলাচল করে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়।
ঘোষপাড়া মোড়ে দেখা যায়, কিছু যুবকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু অটোরিকশা। এরই মধ্যে দ্র্রুত গতিতে চলা একটি অটোরিকশাকে তারা আটকায়। অটোরিকশার চালক গঙ্গাসাগর গ্রামের আবুল খায়ের জানান, আগে নিজ এলাকায় চালালেও দু’দিন আগে নতুন কিনে এখন শহরে এসেছেন। অটোরিকশায় গান বাজানোর ব্যবস্থা থাকতেও দেখা যায়। যুবকরা জানান, কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়াই অটোরিকশা চালাতে গিয়ে ঘোষপাড়া এলাকার মো. শাফায়েত হোসেন পিয়াস নামে এক চালক দুর্ঘটনায় পড়ে এখন বিছানায় কাতরাচ্ছেন।
উপজেলার উমেদপুর গ্রামের ইয়াছিন মিয়ার ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে সানাউল অটোরিকশা নিয়ে এসেছেন সড়ক বাজার এলাকায়। কথা হলে জানায়, কিছুদিন ধরে সে অটোরিকশা চালায়। হীরাপুর গ্রামের বাসিন্দা নিজেকে ১৫ বছর বয়সি দাবি করা নাজমুল জানায়, প্রায় এক বছর ধরেই সে অটোরিকশা চালায়। একই বয়সি রবিন নামে দেবগ্রামের এক যুবকও জানালেন একই কথা। বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গার বিলের ১৫ বছর বয়সি শিশু ইমরান জানায়, সংসারের ব্যয় মেটাতেই বাধ্য হয়ে অটোরিকশা চালায়।
এক শিশুর চালানো অটোরিকশায় বসে থাকা যাত্রী সালমা বেগম বলেন, ‘উঠার সময় খেয়াল করিনি চালক যে এত ছোট ছেলে। আর এত খেয়াল করে কি আর পারা যায়। তবে এখন অটোরিকশায় উঠতে ভয় লাগে। অনেক সময় উপায় না পেয়ে রিকশার বদলে অটোরিকশায় উঠি। তবে মেশিন লাগানোর পর রিকশার চলাচালও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’
সড়ক বাজার দোতলা মসজিদ মার্কেটের ব্যবসায়ি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘অটোরিকশার কারণে পুরো সড়ক বাজারজুড়ে দিনভর যানজট লেগে থাকে। অটোরিকশার সংখ্যা অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। এখন যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে তা খুবই আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
সড়ক বাজারের ব্যবসায়ি সাহিদ হোসেন লিটন বলেন, ‘অটোরিকশা চালকরা মনে করেন পথচারিরা নিজ দায়িত্বে সড়ক দিয়ে চলবে। সড়ক দেয়া হয়েছে অটোরিকশা চলার জন্য। তাই দুর্ঘটনার দায় তাদের নয়। এসব মনোভাব থেকে বেপরোয়া চলাচল করে অটোরিকশাগুলো। ইদানিং যেভাবে দুর্ঘটনা বাড়ছে তাতে এখন লাগাম টানা না গেলে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে ছোট ছোট শিশুদেরকে অটোরিকশা চালনা থেকে যেভাবেই হোক বিরত রাখতে হবে।’
কথা হয় রাধানগর কলেজপাড়ার বাসিন্দা দুই ভাই তানবীর আহমেদ ও তাজবীর আহমেদ নামে দুই ভাইয়ের সঙ্গে। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা পরিষদের সামনে এক বৃদ্ধ অটোরিকশায় আহত হওয়ার বর্ণনা দেন তাঁরা। জানান, বেপরোয়া গতির কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটে।
আখাউড়া দক্ষিণ অটোবাইক শ্রমিক লীগের সাধারন সম্পাদক মো. মাহবুব খান অটোরিকশার একের পর এক দুর্ঘটনার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মূলত একেবারে ছোট অটোরিকশাগুলো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব হালকা এ অটোরিকশাগুলো খুব দ্রুত গতিতে চলে এবং এর চালকরা কেউ-ই একেবারে প্রশিক্ষিত না। যে কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।’
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নূর-এ আলম ও আখাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রসুল আহমেদ নিজামী জানান, দুর্ঘটনার বিষয়গুলো তাঁরা অবগত আছেন। উপজেলা আইনশৃংখলা কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আখাউড়া পৌরসভার মেয়র মো. তাকজিল খলিফা কাজল মঙ্গলবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অটোরিকশাগুলোর যেন লাইসেন্স না দেয়া হয় সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। যে কারণে পৌরসভা থেকে তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। তবে কম বয়সীরা যেন অটো না চালাতে পারে এবং চালকরা যেন প্রশিক্ষিত সে বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।।