May 11, 2024, 9:21 am

কলমে আজ রক্ত নদী

সংগ্রাম মিত্র, ভারত।।

আজকের দিনে আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদার দাবিতে বাংলা ভাষা আন্দোলনে প্রাদেশিক পুলিশ কর্তৃক নৃশংসভাবে এগারো জন ভাষা আন্দোলনকারীকে গুলি বিদ্ধ হতে হয়েছিল | আজ বাংলায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের রক্ত ঝরা দিন |
এ স্মৃতি রক্ত নদী উথাল পাতাল হওয়ার স্মৃতি|
আজ ভোর চারটায় প্রতিদিনের কলম ধরতে গিয়ে দেখি কলমে রক্ত – কলমের প্রতিটি অক্ষর রক্তের অক্ষর | প্রতিটি কালির বিন্দু কালি নয় রক্ত বিন্দু- নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে আমার বুকের উপর দিয়ে ۔۔۔۔|
আজ পালিত হচ্ছে মাতৃভাষা দিবস। আমরা সবাই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় শহীদ হওয়া ভাষা সৈনিকদের কথা জানি। এখন ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় বিশ্বব্যাপী দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। কিন্তু ১৯৬১ সালের ১৯শে মে মাতৃভাষার আন্দোলনকারী ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। তাঁদের আত্মত্যাগে বরাক উপত্যকার কাছাড়, হাইল্যাকান্দী আর করিমগঞ্জ জেলার মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলার এবং পড়াশোনা করার অধিকার পায়।

১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্য ৯০,০০০ বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়। ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
আন্দোলনের সূচনা-
——————-
বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে “কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ” নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। আসাম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে-তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন।

পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখপাত্র রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন, যদি ১৩ এপ্রিল, ১৯৬১ সালের মধ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, তাহলে ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। যার ফলশ্রুতিতে ১২ মে তে আসাম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল। ১৮ মে আসাম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।

১৯ মে’র ঘটনা-
১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে প্রতিবাদ মিছিল করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময় সূচির ট্রেনটি ছাড়ার সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নাই। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে আসাম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়। বিকেল প্রায় ২:৩০ ঘটিকার সময় ন’জন আন্দোলনকারীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। পিকেটিংকারী তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়।

এর পর কেউ একজন লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভেতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু’জন পরে মারা যান। এরপর ২০ মে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে জোর প্রতিবাদ জানায়।

শহীদদের তালিকা-
কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। শহীদ কমলা ভট্টাচার্য হলেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ; তিনি ছিলেন মাত্র ১৬ বছরের কিশোরী। এছাড়াও আসামে বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বিজন চক্রবর্তী নামে একজন শহীদ হন। এছাড়া ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই শহীদ হন আরো দু’জন। তারা হলেন জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস।

এই ঘটনার পর আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে কে “বাংলা ভাষা শহীদ দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। আজকের এই দিনে আসামে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :