April 16, 2024, 11:14 pm

ঢাকা সফরে মোদির ভ্রমণস্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

অনলাইন ডেস্ক।।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬-২৭ মার্চ বাংলাদেশ সফর করবেন। দুদিনের এই সফরে তিনি বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এগুলো হলো, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি।
মোদি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে যাবেন। তিনি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি পরিদর্শন করবেন।
হরিচাঁদ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা জানাবেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের জন্য এই মন্দির পরিদর্শন তাত্পর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে মোদির নেতৃত্বাধীন দল বিজেপির নেতারা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরিশাল জেলার শিকারপুরের সুগন্ধা শক্তিপীঠ (সতীপীঠ) মন্দিরও পরিদের্শনে যাওয়ারও বেশ সম্ভাবনা আছে।
আর হাতে সময় পেলে মোদি কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র কুঠি বাড়িএবং বাঘা যতীনের পৈতৃক বাড়িও দেখতে যাবেন।
মোদির এসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ভ্রমণ বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্যই রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দিক থেকে বেশ তাৎপর্য বহন করে।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ
ঢাকা থেকে প্রায় ৪২০ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়া। বাংলাদেশ স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। এটি সেই জায়গা যেখানে তিনি অনন্য স্থাপত্য শৈলীর একটি সমাধিতে তিনি চিরঘুমে শায়িত রয়েছেন। একদল বেপরোয়া সেনা কর্মকর্তা তাকে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এ দিনটি বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস। প্রতিবছরই এ দিনে শ্রদ্ধা জানাতে লাখ লাখ মানুষ এই স্থানে এসে ভীড় জমায়।
২০২০ সালে শেখ হাসিনাকে আবারও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। তিনি তখন দলের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এর আগে গত ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তিনি তখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়েছিলেন। এটা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের মাজার
মাতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। এ ছিলো ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। শুরু হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে। প্রচলিত আছে, খুব অল্প বয়সেই হরিচাঁদ ঠাকুর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন। এরপরে তিনি বৈষ্ণব হিন্দুধর্মের একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এই গোষ্ঠীর নামই মতুয়া। এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা ছিলেন নামশুদ্র, যারা অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হতো। হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষামূলক এবং অন্যান্য সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে সম্প্রদায়কে উন্নীত করা। সম্প্রদায়ের সদস্যরা ঠাকুরকে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের অবতার বলে মনে করেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মাতুয়ারা অনেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই বা তিন কোটি লোক এ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদিয়া এবং জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং বর্ধমানের ছোট অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামি ২৭ মার্চ থেকে শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট। এখানকার ৩০টি আসনে প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণে মতুয়াদের ভোটের বড় প্রভাব থাকবে। বিজেপি তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে ২০১২ সালের লোকসভা ভোটে তারা বিজেপির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ বিধান নির্বাচনের আগে মোদির ওড়াকান্দি সফর তাই রাজনৈতিক তাত্পর্যপূর্ণ।
বরিশাল জেলার শিকারপুরে ‘সুগন্ধা শক্তিপীঠ’ (সতীপীঠ) মন্দির
মোদি বরিশালের পাশে শিকারপুরে ‘সুগন্ধা শক্তিপীঠে’ও যাওয়ার কথা রয়েছে। সুনন্দ দেবীকে উত্সর্গ করা এই মন্দির হিন্দু ধর্মের কাছে অপরিসীম ধর্মীয় তাত্পর্য বহন করে। এটি ৫১ টি শক্তি পিঠ মন্দিরের একটি। শক্তিপীঠের মন্দিরগুলি হিন্দু ধর্মের শক্তি (দেবী পূজা) ধর্মের সঙ্গে যুক্ত তীর্থস্থান।
শক্তিপীঠের পেছনের গল্পটি হলো, দেবী সতীর আত্মহননের পরে বিরহকাতর স্বামী শিব তাঁর শবদেহ নিয়ে উন্মাতাল বিধ্বংসী নাচ শুরু করেন। বিষ্ণু এই ধ্বংস থামানোর প্রয়াসে সতীর মৃতদেহে সুদর্শন চক্র দিয়ে আঘাত করেন। ফলে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছিটকে পড়েছিল। তার দেহের অংশ যেখানে পড়েছিল সে জায়গাকে শক্তিপীঠ বলা হয়। এদের বেশিরভাগই ভারতে। সাতটি বাংলাদেশে, পাকিস্তানে তিনটি, নেপালে তিনটি এবং চীন ও শ্রীলঙ্কায় একটি করে শক্তিপীঠ আছে। বিশ্বাস করা হয় সুগন্ধা শক্তিপিঠে সতীর নাক ছিটকে পড়েছিল।
অনেকেই মনে করেন, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিকে অবলম্বন করা বিজেপির জন্য এ স্থান পরিদর্শন তাই শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যই বহন করে না, এর মধ্যে দলটির রাজনৈতিক অভিলাষও কাজ করছে।
কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র কুঠি বাড়ি
কুঠি বাড়ি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর নির্মাণ করেছিলেন। একটি দেশীয় বাড়ি। পরে রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত এ বাড়িতেই বসবাস করেন।
এই বাড়িতে অবস্থান কালেই বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সোনার তরী, কথা ও কাহিনী, চৈতালীসহ কয়েকটি মাস্টারপিস রচনা করেছিলেন। তিনি এখানে গীতাঞ্জলির জন্য প্রচুর গান ও কবিতা লিখেছিলেন। এই বাড়িতেই ঠাকুর ১৯১২ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেছিলেন, যার জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন।
বর্তমানে বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত। বর্তমানে এটি ‘ঠাকুর স্মৃতি জাদুঘরে’। রবীন্দ্রনাথের প্রতিদিনের ব্যবহারের বেশ কয়েকটি জিনিস যেমন তার বিছানা, ওয়ারড্রোব এবং তার হাউসবোট এখানে রয়েছে।
কুষ্টিয়ায় বাঘা যতিনের পৈতৃক বাড়ি
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘বাঘা যতীন’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী একজন অনন্য বিপ্লবী। তিনি কুষ্টিয়া জেলার কয়াগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর পৈতৃক বাড়ি আজও আছে। শুধুমাত্র একটি ছোরা নিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করেছিলেন। সেই থেকে তার নাম রটে যায় বাঘা যতীন।
১৯০৬ সালে বিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দিতে গঠিত হয়েছিল ‘যুগান্তর পার্টি’। এরই প্রথম সর্বাধিনায়ক ছিলেন যতীন। যুগান্তর পার্টির নেতৃত্বে অনেক তরুণ বিপ্লবী ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তির লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল।
যতীন উড়িষ্যার বালেশ্বরে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তার লড়াইয়ের ঘটনাটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসে। যতীন ও তার দল ময়ূরভঞ্জের রুক্ষ ভূখণ্ড দিয়ে দুই দিন পায়ে হেঁটে বালেশ্বর রেলওয়ে স্টেশন পৌঁছেছিল। তারা বালেশ্বরের চশখন্ড গ্রামের একটি টিলাতে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আশ্রয় নিয়েছিলেন। এদিকে ব্রিটিশ পুলিশও কাছাকাছি চলে এসেছে। দলের অন্য সদস্যরা যতীনকে নিরাপদে জায়গাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তবে সাহসী যতীন তার অনুসারীদের ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
এরপরে, ব্রিটিশ সেনাকর্মকর্তা ও পুলিশের এক বিশাল ব্যাটালিয়ন চারদিক থেকে পাঁচ বিপ্লবীর ওপর আক্রমণ চালায়। যতীনদের দলের সদস্যরা ঐতিহ্যবাহী মাউসার পিস্তল দিয়েই লড়াই চালিয়ে গেছেন। এ যুদ্ধে যতীনের তলপেটে গুলি লাগে এবং পরের দিন ১০ সেপ্টেম্বর ৩৫ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান বিপ্লবী এ মহানায়ক। এ মহানায়কের পৈত্রিক বাড়ি সফল তাই মোদি ও তার দলের কাছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদি রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ
২৬ মার্চ মোদি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের নকশায় নির্মিত স্মৃতিসৌধটি ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধন করা হয়। এটি বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ। একাত্তরের যুদ্ধে প্রাণ হারানো সেনাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল।
স্মৃতিসৌধের নকশায় সাত জোড়া ত্রিভুজাকার প্রাচীর রয়েছে। প্রতিটি জুটি বাংলাদেশের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সময়কে উপস্থাপন করে: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক নির্বাচনের বিজয়, ১৯৫৬ সালে সংবিধান আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে–দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং অবশেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে আবির্ভূত হয়।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :