July 27, 2024, 2:45 pm

দুদকের নজর সরকারি দপ্তরে

অনলাইন ডেস্ক।।
সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি কমাতে তাদের বেতন দ্বিগুণ করা হলেও দপ্তরগুলোতে এর প্রভাব পড়েনি তেমন। বেতন বাড়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনমানে জৌলুস বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি। বেতন বাড়ানোর পরও দেখা গেছে, গত ৩ বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আরো বেড়েছে। কাস্টমস, ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ওয়াসা এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরতদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই দুদকে আসছে বিস্তর অভিযোগ। দুদক বলছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ঠেকাতে দপ্তরগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি কমবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনমানে উন্নতি ও দুর্নীতি কমাতে ২০১৫ সালে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করে সরকার, ২০১৬ সালের ১ জুলাই যা কার্যকর হয়। বেতন-ভাতা বাড়িয়ে সরকারের তরফে বলা হলো, নতুন কাঠামোতে বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের জীবনমান বাড়বে, ফলে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, দুর্নীতি কমেনি। দুদকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুর্নীতির মামলায় ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। তাদের মধ্যে ৪ শতাধিক? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে দুদকে লিখিত অভিযোগ জমা হয় ১২ হাজার ৫০০টি, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫, ২০১৬ সালে ১৩ হাজার, ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৯৮৩, ২০১৮ সালে ১৭ হাজার ও ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি। এসব লিখিত অভিযোগের প্রায় অর্ধেকই সরকারি দপ্তরসংক্রান্ত।
এছাড়া ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই দুদকের হটলাইন চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ফোনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ২ লাখের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। দুদকে আগে জমা পড়া কয়েক বছরের অভিযোগ বিশ্লেষণ করেও দেখা যাচ্ছে সূচকটি ঊর্ধ্বমুখী। বেড়েছে দুদকের গ্রেপ্তার ও ফাঁদ মামলার সংখ্যাও। দুদকের নথিপত্র বলছে, সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে ভ‚মি প্রশাসন, আর্থিক খাত, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট অফিসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি আসছে, অন্য পেশার মানুষের সম্পর্কে অভিযোগ খুবই কম।
এছাড়া টিআইবির সর্বশেষ জরিপেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) সর্বশেষ খানা জরিপ-২০১৮ তে এ তথ্য উঠে আসে। ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট জরিপটি প্রকাশ করে টিআইবি। জরিপে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালে টিআইবি সর্বশেষ খানা জরিপ করে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ তে ঘুষের পরিমাণ ২১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালের জরিপের তথ্য অনুসারে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এরপর রয়েছে যথাক্রমে পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা ও ভ‚মি সেবা। জরিপ প্রকাশের দিন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেছেন, দুর্নীতির সঙ্গে বসবাস করার সংস্কৃতি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এটা জাতিগতভাবে অসম্মানজনক ও অমর্যাদাকর।
দুর্নীতির এ ব্যাপকতা থেকে উত্তরণে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। সে অনুযায়ী সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ২৫টি দল গঠন করা হয়। দুদকের মামলায় সম্পৃক্ত অবৈধ সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্যও পৃথক ইউনিট গঠন করা হয়। এর মধ্যে অনুসন্ধান শেষে সরকারি দপ্তর ও সেবা সংস্থাগুলোতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধের জন্য ১৫টি মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বিগত সাড়ে ৪ বছরে প্রায় ১০০টি ফাঁদ মামলা পরিচালনা করে প্রায় ১০০-এরও বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যার মধ্যে আলোচিত ছিল পুলিশের ডিআইজি মিজান ও দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরের ৪০ লাখ টাকার লেনদেন কাণ্ডও। এ ঘটনায় ২ জনই গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে আটক আছেন। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চলছে। এরপর চলতি বছর করোনাকালীন সবচেয়ে আলোচিত স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ও কর্মচারী আবজাল হোসেনকে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে দুদক। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগে গত বছর দুদক যাদের তলব, জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলার আসামি করেছে, তাদের অধিকাংশই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এর আগে আয়বহির্ভূত ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ আমিনকে গ্রেপ্তার করে দুদক। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নিজ কার্যালয়ে ঘুষের টাকাসহ দুদকের জালে ধরা পড়েন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম। নৌযানের নকশা অনুমোদনের জন্য ঘুষ লেনদেনে অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এর ৬ মাসের মাথায় ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ একই অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সেগুন রেস্টুরেন্ট থেকে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন। একইভাবে আয়বহিভর্‚ত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সিভিল এভিয়েশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসির উদ্দিনকে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে দুদক। দুর্নীতির অভিযোগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এনামুল ইসলামকে দুদক গ্রেপ্তার করে ২০১৭ সালের ২ মার্চ। পরিদর্শনের পর একটি বিদ্যালয়ের পক্ষে প্রতিবেদন দেয়ার শর্ত হিসেবে ‘ঘুষ হিসেবে নেয়া’ ২ লাখ টাকাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমানকে ২০১৭ সালের ৩০ মে গ্রেপ্তার করে দুদক। ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি ঘুষের টাকাসহ দুদকের হাতে ধরা পড়েন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন আহমেদ। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে দুদক।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বেতন যদি জীবনধারণ ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে দুর্নীতি কমে আসা উচিত বলে ধরা হয়। এটা প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। যারা দুর্নীতি করেন, তারা শুধু বেতন-ভাতা কম পেলেই দুর্নীতি করেন, বিষয়টি এমন নয়। অনৈতিকতা, আইনের লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ বৃদ্ধির উপায় হিসেবেও তারা দুর্নীতি করেন। বেতন-ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দিতে হবে। এই বিষয়গুলো পাশাপাশি হয়নি বলেই বেতন বৃদ্ধি সত্তে¡ও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাই না।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :