May 19, 2024, 5:46 am

অক্টোবরে বিএনপি দেখছে সম্ভাবনা, আওয়ামী লীগ বলছে সম্ভব না

দেশে কী হতে চলেছে এই অক্টোবর মাসে? আগামী সপ্তাহ থেকেই কি অস্থির হয়ে উঠবে রাজনীতি? বিএনপির এক দফার আন্দোলন এবং বিদেশি চাপে সত্যিই কি সরকার পদত্যাগ করবে? তেমন এক দফার আন্দোলন গড়ে তোলার সক্ষমতা কি বিএনপির আছে? বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম কি আদৌও ফলপ্রসূ হবে? তেমন আন্দোলন গড়ে তোলার নেতৃত্বই বা দেবে কে?
এমন ধরনের নানা প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে চায়ের দোকান,সর্বত্র আলোচনার ঝড় উঠছে। এসব প্রশ্নে বিএনপির সমর্থকরা অতীত ইতিহাস টেনে ‘অক্টোবর’ এক সম্ভাবনার মাস হিসেবে সফলতার দাবি করছেন। অপরদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বলছেন, লাগাতার এক দফার আন্দোলন গড়ে তোলার নেতৃত্ব কিংবা সক্ষমতা তেমন কোনো কিছুই নেই বিএনপির। তাদের নেতা কে, তা নিয়ে বিএনপির মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। আর সর্বশেষ দলের মহাসচিবের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামের সময় শেষ হলেও আর কোনো কর্মসূচি কিংবা দিক নির্দেশনা না থাকায় দলীয় নেতা-কর্মীরাই হতাশায় ভুগছেন। এ অবস্থায় আর যাই হোক অন্তত বিএনপিকে দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব না বলেই বিশ্বাস করছেন সাধারণ মানুষ।
চলতি অক্টোবর মাসের সম্ভাব্য আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে বিএনপির অনেক দায়িত্বশীল নেতাও মনে করেন, দেশের জনগণের উত্তাল আন্দোলন আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলতি অক্টোবরেই বিদায় নেবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য। এমনটি হলে বিএনপিকেই জনগণ আবারও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করবে। কেননা এ মাস ঘিরেই রয়েছে বিএনপির উত্থান-পতনের নানান ঘটনা।
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনে জয়লাভ করে ১০ অক্টোবর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। আবার ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল এ সরকারের শেষ দিন। কয়েক মাসের টানা আন্দোলন সংগ্রামের পর আবারও এসেছে চলতি বছরের অক্টোবর। এ মাসেই সরকার বিদায় হবে! তাদের আশা, ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে বিএনপি। এবারও তেমনটি হবে!
এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ যে পথে চলছে তাতে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। অক্টোবরেই আওয়ামী লীগের পতন হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অক্টোবর মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলমান কর্মসূচি আরও বেগবান হবে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কর্মসূচি নির্ধারণ হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার সাংবাদিকদের বলেন, এক দফার আন্দোলনে সারাদেশে সব পেশার মানুষ ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছে। ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনগুলোও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এবার ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি আর করতে দেয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিএনপির গণআন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের পতন, ২০০১ সালের অক্টোবরে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন। সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাসে অক্টোবর, নভেম্বর ডিসেম্বর-এ তিন মাস বিএনপির রাজনীতির জন্য ঘটনাবহুল এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, কী ঘটবে এই অক্টোবরে এমন বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা উপহাস করেছেন। তাদের অনেকের মতে, বিএনপি কিছুই ঘটাতে পারবে না। সেই সক্ষমতা তাদের নেই। এ দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম খালেদা জিয়া ইস্যুতে যে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন, তা নিয়ে দেশব্যাপী হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। মির্জা ফখরুল হয়তো ভেবেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা খুবই নাজুক। কাজেই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কিছু একটা ঘটবে। ফলে রাগে দুঃখে সারাদেশে বিএনপির সব নেতাকর্মী রাস্তায় নেমে আসবে। আর এতে একটু ঝাঁকি দিলেই সরকারের পতন হয়ে যাবে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও কিছু ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গত সোমবার কুষ্টিয়ায় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে বলেন, বিএনপি আইন মানে না, বিচার ব্যবস্থা মানে না। এটাই প্রমাণ করে তাদের মধ্যে কোনো শিষ্টাচার নেই। সবসময় তাদের মধ্যে সন্ত্রাসী মনোভাব বিদ্যমান। বিএনপি আসলে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে এটা নিয়ে রাজনীতি করাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এটাকে একটা রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে ব্যস্ত তারা। এ নিয়ে তারা কথাবার্তা বলছে, সভা-সমাবেশ করছে, কিন্তু আদালতে যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন,গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ‘বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে, আর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে’ এমন গুজব ছড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ছিল দলটি। সাধারণ মানুষের মনেও অজানা আতঙ্ক বিরাজ করেছিল কী যেন হয় ১০ ডিসেম্বর! আবারও সেই পথে হাঁটছে বিএনপি। এবার তারা এ মাসেই অর্থাৎ অক্টোবরেই বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে বলে দেশবাসীকে বিশ্বাস করাতে চাইছে।
তারা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে বর্তমান সরকার পতনের একদফা দাবিতে সরব হয় বিএনপি। কিন্তু এরমধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সুষ্ঠু নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করছে। দাবি ও দফার ক্ষেত্রে বিএনপি স্পষ্ট করতে পারেনি যে তাদের দফা আসলে কয়টি। কখনো ৩১ দফা, কখনো ১০ দফা, এরপর এখন একদফার আন্দোলনেও একই অবস্থা। সর্বশেষ, দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক ‘গুটি’ হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্রে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিল গত ২৪ সেপ্টেম্বর। ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও বিএনপি কিছুই করতে পারেনি। আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর দলের মহাসচিব আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন বলেছিলেন। অর্থাৎ, আল্টিমেটামের মধ্যে কাজ না হলে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্তই তাদের ছিল না। ফলে, কোনো আন্দোলনেই জনসম্পৃক্ততা পায়নি দলটি। সিদ্ধান্তহীনতা, নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব,সমন্বয়হীনতার কারণে কোনো আন্দোলনেই যেমন দৃশ্যমান সফলতা আসেনি। তেমনি বারবার দলের নেতাকর্মীদেরকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা বলছেন, ২০১১ সালে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে ঈদের পরে তীব্র আন্দোলন হবে। সে বছর ঈদ এসেছিল ঠিকই, কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে আন্দোলন করার কথা ভুলে গিয়েছিল বিএনপি। একইভাবে ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালেও ঈদের পরে কঠোর আন্দোলন ঘোষণা করেছিলেন খালেদা জিয়া। প্রতি বছর ঈদ এলেও খালেদা জিয়ার সেই আন্দোলন আর আসেনি। বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান ২০২২ সালে ঘোষণা করেছিলেন ১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে। কিন্তু গত ১০ ডিসেম্বর ‘ঈদের পর আন্দোলনের’ মতোই ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের র‌্যাবের ওপর স্যাংশন এবং ভিসানীতির কারণে সরকার কিছুটা চাপে আছে বলে মনে করে বিএনপি। এজন্য মাঠের আন্দোলনের চেয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের দিকে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় আছে বিএনপি নেতৃত্ব।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার মনে করেন, বিএনপি বিগত এক বছর ধরে যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে তাতে তাদের দাবি আদায় বা লক্ষ্য পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বিদেশি চাপের কথা বলে ও ষড়যন্ত্র করে যে চাপ দিতে চাইছে তাতে আওয়ামী লীগ বিচলিত না। এ অবস্থায় যদি সমঝোতার কথা সামনে আসে, তাহলে প্রশ্ন হলো, সমঝোতা হবে কোন বিষয়ে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি উচ্চ আদালতের আদেশে বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ, ২০১৮ সালের মতো বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া কোনো সমঝোতার পথ বিএনপির সামনে খোলা নেই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :