April 18, 2024, 11:04 pm

খুব খুশি অইছি প্রধানমন্ত্রী আমরারে দেখাত আইছইন। তিনদিন থাকি চিড়ামুড়ি খাইয়া আছি

অনলাইন ডেস্ক।
শেখর বেটি আইচ্ছন এবলা আর কুনও দুখ (দুঃখ) নাই। এবলা আমরা খানি-ফানি (খাদ্য) পাইমু। আল্লাহ শেখর বেটিরে আরও বাছাউক্কা (বাঁচান)।’ কথাগুলো সিলেট সদরের মেরিন একাডেমি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠা উমাইরগাঁও এলাকার বৃদ্ধা আলেয়া বেগমের। গতকাল দুপুরে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘খুব খুশি অইছি প্রধানমন্ত্রী আমরারে দেখাত আইছইন। তিনদিন থাকি চিড়ামুড়ি খাইয়া আছি। সকালে একজনে পাতলা খিচুড়ি দিছে পেট ভরিয়া খাইছি।’

একই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠা সদরের হাটখোলার লাইলি আক্তার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আসার খবরে আমরা খুশি। বন্যায় আমার বাড়িঘর ভেসে গেছে। করোনায় স্বামী হারিয়েছি দুই বছর আগে। এক বাচ্চা নিয়া বড় কষ্টে আছি।’ ঘর মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি জানান এই অসহায় নারী।

এদিকে এখনো সিলেটে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই। ত্রাণ পাচ্ছে না মানুষ। খাবারের জন্য আর্তনাদ। এখনো পানির নিচে লাখ লাখ মানুষ। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন জেলা। দুর্গত এলাকায় দুর্ভোগ চরমে। নৌকা, স্পিডবোট, ট্রলার দেখলেই মানুষ দৌড়ে যাচ্ছে। কেউ খাবারের জন্য আবার কেউবা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সাহায্যের আকুতি। এমন পরিস্থিতিতে আউলিয়ার শহরে মানবিক বিপর্যয় দেখে আসলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কথা বলেছেন মানুষের সাথে। দুর্যোগে দৃশ্যপটে বড় আশার আলো জেগেছে।

প্রধানমন্ত্রীও বললেন, তিনি ঢাকায় বসে সিলেটের সব মানবিক ছবি সংগ্রহ করেছেন। তাৎক্ষণিক ছবিগুলো সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রীয় বিশেষ অফিসে, বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। যাতে মানুষকে দ্রুত উদ্ধার করা যায়। এমন ঘোষণাও দিয়ে এসেছেন সিলেট অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সহায়তা দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের যত খাদ্য ও ওষুধ লাগবে সব দেয়া হবে। মাছচাষিরা যাতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন, সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিলেট অঞ্চলে আর উঁচু করে কোনো রাস্তা করা হবে না। এলিভেটেড রাস্তা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুরো সিলেটজুড়ে একটা স্বস্তির আভাস মিলছে। ভারতের সাথে সৃষ্ট সমস্যা আলোচনায় সমাধান হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। বিএনপিপন্থি সিসিকের মেয়র আরিফ হোসেনও বললেন, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি অসহায় মানুষদের মধ্যে আশার আলো এসেছে। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু এসেছেন, সিলেটে এবার কার্যকরী একটা ব্যবস্থা হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের শুকনো খাবারের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় আবেদনে বলেন, সিলেটে উঁচু ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প উদ্যোগ জরুরি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বিকেলে আমার সংবাদকে বলেন, গত নির্বাচনি জনসভায় সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সিলেটের সব উন্নয়নের দায়িত্ব তার হাতে। আমাদের দাবি হলো— সরকারের প্রত্যেক প্রশাসনিক দপ্তরকে যেন তিনি সিলেটের উন্নয়নে গুরুত্ব সহকারে কাজ করার নির্দেশ দেন। একই সাথে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসেন। যাতে মানুষকে আর ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।

বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ৫৭টি নদ-নদীর ৫৪টির উৎসমুখ ভারতে। সুতরাং এ ব্যাপারে ভারতের সাথেও সরকারের আলোচনা করা উচিত। যাতে ভারত বানের পানি ছাড়ার অন্তত তিন থেকে চারদিন আগে বাংলাদেশকে জানায়। এতে করে আগাম সতর্কতা নেয়া সম্ভব হবে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতিও কমে আসবে।এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, নদী খনন, ড্রেন বা জলাশয় উদ্ধারসহ বন্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন, সিলেটের উন্নয়ন যা যা লাগে সব করা হবে। পাশাপাশি বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী ও ওষুধপত্র যাতে সঠিকভাবে পৌঁছানো হয় সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছেন।

বন্যায় প্রাণ গেল ২৪ জনের : বন্যায় সিলেট বিভাগে এ পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়। অধিপ্তরের পরিচালক হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘এ পর্যন্ত বন্যায় সিলেট বিভাগে ২৪ জনের মৃত্যুর তথ্য আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে সিলেটে ১৫ জন, মৌলভীবাজারে তিনজন ও সুনামগঞ্জে ছয়জন।’ তবে প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। দুই জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সব তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

ভেসে উঠল মা-ছেলের লাশ : সিলেটের জৈন্তাপুরে বানের তোড়ে নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর এক নারী ও তার ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টায় উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের হাওর থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর জানান। মৃতরা হলেন— উপজেলার দরবস্ত ইউপির মহালীখলা গ্রামের মৃত আজব আলীর স্ত্রী নাজমুন নেছা (৫০) ও তার ছেলে আব্দুর রহমান (১৪)।

খাবারের জন্য আর্তনাদ : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফের বন্যায় প্লাবিত সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা। উপজেলার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে গৃহবন্দি আছেন উপজেলার প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ। গত ১৬ জুন রাত থেকে উপজেলা সদরের সাথে সব ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। নেই বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সব রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।

প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর, হাটবাজার, গুচ্ছগ্রাম, ধর্মীয় উপসনালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে রোববার থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতি কিছু উন্নতির পথে। পানিবন্দি পরিবারের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অনেকের ঘরে পানি প্রবেশ করায় খাবার রান্না করা তো দূরের কথা পরিবারের সদস্যদের বিশ্রামের জায়গা নেই। এই ভয়াবহ অবস্থায় মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। রয়েছে তীব্র খাবার সংকট।

এখনো ৪৫ লাখের বেশি মানুষ ডুবে আছে : সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও সিলেট সেনানিবাসের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বন্যা ও এর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা তুলে ধরেন। বিভাগীয় প্রশাসন জানিয়েছে, চারটি জেলার ৩৩টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেখানে ৪৫ লাখের বেশি মানুষ বন্যার পানিতে ডুবে আছে এবং ১৪ লাখের বেশি মানুষ ১২৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

এছাড়া, বন্যাদুর্গতদের চিকিৎসার জন্য ৩০০টিরও বেশি মেডিকেল টিম কাজ করছে এবং ২৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, নগদ দুই কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ১৩০৭ মেট্রিক টন খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বন্যায় ৭৪ হাজার হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে এবং ৪০ হাজার পুকুর ও হ্যাচারি বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে আনুমানিক ১৪২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বর্ষণে নড়বড়ে বাড়িঘর ধসের আশঙ্কা : সিলেটের গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে বিপর্যস্ত বিভিন্ন বাড়িঘর, মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবারগুলো। কয়েক দিনের টানা বর্ষণে টিলা ধসে বিভিন্ন বসতভিটা বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এলাকার সচেতন মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সময় উপযোগী কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে এবং আশঙ্কাযুক্ত ঘরবাড়ি নিরাপদে না রাখলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এ ব্যাপারে পোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. গোলাম বলেন, ‘আমরা ওই জায়গা পরিদর্শন করেছি। খোঁজ নিয়ে পৌর এলাকার টিলাধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করব।

ভেসে গেছে ৭১ কোটি টাকার মাছ : সিলেটে দুই দফা বন্যার পানিতে ৩০ হাজার ২৫৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ তথ্য জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, সিলেটের ১৩টি উপজেলায় ৩০ হাজার ২৫৫টি পুকুরের ২৫ হাজার ২৪০ জন খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরের মোট আয়তন তিন হাজার ৩৯৯ হেক্টর। বন্যার পানিতে তিন হাজার ৫০৯ মেট্রিক টন মাছ ও ৩২৮ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছের মূল্য ৫৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা, পোনার মূল্য ৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর বাইরে তিন কোটি ২৭ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে খামারিদের।

বিমানের ত্রাণ কেড়ে নিলো বিপ্লবকে : সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বন্যাদুর্গতদের জন্য হেলিকপ্টারে করে বিমান বাহিনীর দেয়া ত্রাণসামগ্রী নিতে গিয়ে বিপ্লব মিয়া নামে এক অভুক্ত যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এসময় আরও পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য নেয়া হলে সেখানেই বিপ্লব মিয়ার (৪৫) মৃত্যু হয়। তিনি উপজেলা সদরের উজান তাহিরপুর গ্রামের শহীদ আলীর ছেলে। নিহত বিপ্লব দুই ছেলে ও দুই কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন। জানা যায়, বন্যাকবলিতদের বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার উপর থেকে সেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে। এ সময় নিচ থেকে ত্রাণ নিতে গিয়ে বিপ্লবসহ আরও পাঁচজন আহত হয়। গুরুতর আহত বিপ্লবসহ ছয়জনকে তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে আহত বিপ্লবের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গতকাল সকালে সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল ভর্তি করা হলে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তাহিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল লতিফ তরফদার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ত্রাণ নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে গুরুতর আহত বিপ্লব নামে একজন সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :