April 16, 2024, 2:01 pm

অর্ধেক জনবলে চলছে যশোর শিক্ষাবোর্ড যশোর শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসির সনদে ভুল বানান : সনাক্ত হয়নি জড়িতরা

তহীদ মনি।। যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ২০২১-এর সনদপত্রে Higher বানান ভুলের সাথে জড়িতদের সনাক্ত করতে পারেনি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি। শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এটা গ্রুপগত এবং রিজনেবল ভুল তাই আর্থিক দায় নিতে হচ্ছেনা জড়িত কারোরই। বোর্ডকেই এই আর্থিক ক্ষতি মানতে হচ্ছে। সে ক্ষতি বিপুল অঙ্কের হলেও চেয়ারম্যানের দাবি ১২ লাখের বেশি নয়। ফলে ওই বছরের ১ লাখ ২৬ হাজার সনদপত্র বাতিল করে পুনরায় ছাপাসহ নতুন করে খরচ করতে হলো বোর্ডকে। বোর্ডের কয়েক লাখ টাকার গচ্চা গেলেও পার পেতে যাচ্ছেন ভুলের সাথে জড়িতরা।

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ধরা পড়ে বোর্ডের ১ লাখ ২৬ হাজার সনদের ভুল। এইচএসসি উত্তীর্ণ ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৪১ শিক্ষার্থীর জন্য এই সার্টিফিকেট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন আচরণে সনদপত্রে ইংরেজিতে Higher -এর স্থলে লেখা হয় Highre। এ ধরণের ভুলের কারণে নতুন করে ছাপতে হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার সনদ। তবে ওই সময় বোর্ড চেয়ারম্যানের দাবি ছিল, ক্ষতির দায় বোর্ড নেবে না, যার বা যাদের অবহেলায় এই ভুল, ক্ষতির দায় বর্তাবে তাদের ওপর । এ কারণে সে সময় ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম। সদস্য ছিলেন উপ কলেজ পরিদর্শক মদন মোহন দাশ এবং প্রশাসন ও সংস্থাপন উপ সচিব মোছা. জাহানারা খাতুন। গত বছরের অক্টোবর মাসে তারা তদন্ত রিপোর্ট বোর্ডে জমা দেয়।

তদন্ত রিপোর্টে ওই কমিটি ৩টি সুপারিশ করেছে। সে সুপারিশে কাউকে দায়ী না করে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম অনেকটা এরকম-
সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট জাহাঙ্গীর কবির মূল সনদের নমুনা কপির ‘প্রুভড’ কপি পদ্ধতিগতভাবে অনুমোদন ও সংরক্ষণ করেননি। তবে তিনি তার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। বানান ভুল থাকা সত্বেও গ্রুপ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাতে স্বাক্ষর করেছেন এবং জাতীয় মূল সনদের নমুনা কপি অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি তাই এমন ভুল ঘটেছে। অবশ্য এর জন্যে ওই রিপোর্টে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হয়নি। সেখানে কে এই সনদ বিতরণ করেছেন, কার দৃষ্টিতে এই Higher বানান প্রথমে ধরা পড়ে, সব সনদ মুদ্রণ হওয়ার পর ভুল ধরা পড়ে এবং অধিকাংশ কর্মকর্তা এতে স্বাক্ষর করেছেন, কেমন করে এই সনদ হস্তান্তর হলো সব কিছু পর্যক্ষেণে লেখা হলেও নমুনা কপি মুদ্রণ ও অনুমোদন বা সংরক্ষণে ব্যর্থতার দায় রাখা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, কাজের প্রথমেই অডিট বিভাগ থেকে এই ভুল ধরা পড়ার পর তৎকালীন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তারা বিষয়টি আমলে নেননি।

বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার যে সনদপত্র বা সার্টিফিকেট দেওয়া হয় তার কাগজ কেনা হয় সাধারণত অস্ট্রেলিয়া থেকে। কোটেশনের মাধ্যমে কাগজ কেনার পর সরকার নিয়ন্ত্রিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে বোর্ডের মনোগ্রাম, তার নিচে বড় অক্ষরে শিক্ষা বোর্ডের ও পরীক্ষার সালসহ নাম ছাপা হয়। এর নিচের অংশ ছাপা হয় শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার বিভাগ থেকে। সেখানে শিক্ষার্থীর নাম, পিতা-মাতার নাম, কেন্দ্রের নাম ও নম্বর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম, প্রাপ্ত জিপিএসহ পরীক্ষার নাম এবং ফলপ্রকাশের তারিখসহ অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করা হয়।

নিচের অংশ ছাপার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতির পর একটি নমুনা সনদপত্র তৈরি করা হয়। ওই নমুনা ছেপে সংশোধনের জন্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিভাগসহ সংশোধনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক চূড়ান্ত করলে ছাপার কাজ শুরু হয়। পুরো কাজটির দায় থাকে তার উপর।

২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতি অনুসরণ করাও হয়। এরপরও সনদপত্রের নিচের অংশে রোল নম্বরের পর যেখানে পরীক্ষার নাম লেখা হয়েছে সেখানে Higher (উচ্চ) শব্দটি ভুল বানানে লেখা থাকা অবস্থায় ছাপা হয়ে যায়। সনদপত্র বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর জন্য বোর্ডের সংশি¬ষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্যে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করেন। সে সময় ভুলটি ধরা পড়ে।

এদিকে বানান ভুল ধরা পড়ার পর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সভায় বসেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ভুল বানানটি কালো কালি দিয়ে ঢেকে তার উপর সংশোধিত বানান সংযোজন করার। সে কাজটিও করা হয়। কিন্তু বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি পক্ষ এমন কালিযুক্ত সনদপত্র শিক্ষার্থীদের কাছে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুললে সংশোধিত ওই সনদপত্র আর দেওয়া হয়নি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা সনদ পেতে বিড়ম্বনায় পড়ে। পরবর্তীতে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নতুন সনদ তৈরির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। একই সময় বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীব একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। সে সময় যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মাধব চন্দ্র রুদ্র সনদপত্রে ভুল বানানের কথা স্বীকারও করেছিলেন। দায় মুক্তির বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে জানান, চেয়ারম্যান অনুমতি দিলে কারা জড়িত বা কীভাবে তদন্ত করা হয়েছে সব কিছু জানাবেন।

শিক্ষা বোর্ডের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একটি সার্টিফিকেট তৈরিতে কাগজ কেনা, সিকিউরিটি প্রেস ও সেখানকার ছাপাসহ পরিবহন ও অন্যান্য খাতে প্রায় ২৫ টাকা খরচ হয়। তাছাড়া শুধু বোর্ডে ছাপা থেকে শুরু করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পর্যন্ত স্বাক্ষর, দলবদ্ধভাবে তথ্য যাচাই, স্বাক্ষর প্রদান, অভ্যন্তরীণ পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে ৬৪ টাকা করে খরচ হয়। সে হিসেবে সনদপত্র শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছাতে প্রতিটির জন্যে বোর্ডের ব্যয় হয় ৮৯ টাকা। এ হিসেবে ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৪১টি সনদপত্রের জন্যে যশোর শিক্ষা বোর্ডের ব্যয় ১ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার ৯৪৫ টাকা।

অবশ্য বোর্ড চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, একই সনদের জন্যে কর্মকর্তা, কর্মচারী, পরীক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট খাতে দুই বার অর্থ দেওয়ার সুযোগ নেই শুধু কাগজ কেনা ও প্রিন্টিং ব্যয় অতিরিক্ত হয়েছে। তার মতে, সে ব্যয় কোনোভাবেই ১২ লাখ টাকার বেশি নয়। তার হিসাব সঠিক হলে বোর্ডকেই কারণ ছাড়া ১২ লাখ টাকা ক্ষতির দায় নিতে হচ্ছে। তিনি অডিট রিপোর্টকে ভিত্তি ধরলেও তা কত আগে জমা হয়েছে তা জানাতে রাজি হননি বা এত দিন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তারও ব্যাখ্যা দিতে রাজি হননি তিনি।

বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীব বলেন, এ বিষয়ে সরকারি অডিট হয়েছে। অডিট রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এটি একটি দলগত কাজ। ঠিক কার কাছ থেকে ভুলটি হয়েছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। সর্বশেষ এটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে শেষ হয়। এক্ষেত্রে বিচার বিশ্লেষণ করে যদি দেখা যায় ‘ক্ষতির পরিমাণটি রিজনেবল হয়’ তবে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :