April 28, 2024, 5:17 pm

ইফতার-সেহরির সময়ও থাকে না বিদ্যুৎ : গরমে বাড়ছে শিশুরোগী

চুয়াডাঙ্গার পর এবার পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার এ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহওয়া অফিস। চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই করছে। গতকাল সোমবার চুয়াডাঙ্গা ও রাজশহীতে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। একদিকে প্রচ- গরম অপরদিকে ঘন ঘন লোডশেডিং। এ দুইয়ে মিলে বিপর্যস্ত চুয়াডাঙ্গার জনজীবন। মানুষের সঙ্গে প্রাণিকূলের অবস্থাও ওষ্ঠাগত। জমিন শীতল হতে প্রকৃতির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রাণিকূল। সকাল ৭টার পর থেকে সূর্যের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। দুপুরে তীব্রতা আরও বেশি। রোজাদারের জন্য কষ্ট বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রচ- এ গরমে সবচেয়ে বিপদে আছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলো। রোদে তাকালেই চোখ যেন ঝাপসা হয়ে আসে। টানা গরম আর অনাবৃষ্টিতে মানুষের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। গরম বাতাস শরীরে লাগছে আগুনের হলকার মতো। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। এর মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে এসেছে ঘন ঘন লোডশেডিং। লোডশেডিং হলে বাসার মধ্যে যেন দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি। এদিকে, চুয়াডাঙ্গায় তীব্র গরমে শিশুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সদর হাসপাতালটিতে শয্যার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি শিশুরোগী ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃর্তপক্ষ।

দীর্ঘদিন ধরেই চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ভয়াবহ তাপমাত্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। গত ২ এপ্রিল থেকে প্রতিদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই জেলায়। গতকাল সোমবার বিকেল ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ১৮ শতাংশ। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা ২৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে গত রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, প্রতিদিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড হচ্ছে। গত টানা ১৫ দিন ধরে জেলায় সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। সোমবার সকাল ৯ টায় ছিলো ৩১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর দুপুর ১২টায় তাপমাত্রা বেড়ে ৩৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি হয়ে যায়। এরপর বেলা ৩টায় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। শুরু হয় অতি দাবদাহ। আকাশ আংশিক মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে তবে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। দিনের চাইতে রাতের তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। তিনি আরো বলেন, চুয়াডাঙ্গায় তেমন নদ-নদী নেই। যা আছে সেগুলো প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। সেচ কাজের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ভুগর্ভস্থ পানি উঠানো হচ্ছে। এতে পানির স্তর নীচে থেকে আরো নীচে নেমে যাচ্ছে। গাছ-পালার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়াও কক্রটকান্তি রো বরাবর চুয়াডাঙ্গার অবস্থান হওয়ায় এ জেলায় গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে। এদিকে চুয়াডাঙ্গায় টানা ১৫ দিন ধরে তীব্র দাবদহে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে অতি দাবদাহ। সেই সাথে ক’দিন ধরে দিনে-রাতে যুক্ত হয়েছে অসহনীয় লোডশেডিং। এতে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে জনজীবন।

ঝাঁঝাঁলো রোদ আর গরমে রোজাদারদের অবস্থাও ওষ্ঠাগত। সামনে ঈদ। তাই মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে বাইরে বের হচ্ছে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে বাইরে বের হওয়া দায় হয়ে পড়ছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছে না কেউ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে যাতে হিটস্ট্রোক, পানি শুন্যতা ও ডায়রিয়া আক্রান্ত না হয় সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মানুষ ডায়রিয়া, পানি শুন্যতায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে তীব্র রোদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এ রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুন ঝরা রোদের তেজে বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা বিরাজ করছে সূর্য একেবারে ডুবে যাবার আগ পর্যন্ত। চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে কষ্টে পড়েছে খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক ও কৃষকেরা। তীব্র রোদে মাঠে টিকতে পারছে না কৃষক ও দিনমজুর। রাস্তায় ভাড়া মারতে পারছে না রিক্সা-ভ্যান চালকরা।

এদিকে তীব্র খরায় ঝরে যাচ্ছে আম-লিচুর গুটি। বোরো ধান, সবজি ক্ষেতে প্রতিদিন সেচ দিতে হচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। বাড়তি দামে প্রতিদিন ডিজেল কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস ছুটে যাচ্ছে তাদের। প্রচ- গরমের মধ্যে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। ইফতার, তারাবিহ ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় সেচযন্ত্র ঠিকমতো চলছে না। এতে ফসলি জমিতে সেচকাজও ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জেলায় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ কম সরবরাহ করা হচ্ছে। এজন্য দিনে ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে। এদিকে, জেলার প্রতিটি এলাকাতেই এমন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সংশ্লিদের প্রতি ক্ষোভ জানাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

শহরের বাসিন্দা হোসেন আলী বলেন, রমজানের শুরু থেকে কিছুটা লোডশেডিং থাকলেও এখন তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। দিন-রাত মিলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ইফতার, তারাবিহ ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে রাতের খাবার খাওয়াসহ অন্য কাজ করতে হচ্ছে।

পৌর এলাকার বাসিন্দা মো. লতিফ মিয়া বলেন, দিনের বেলায় বিদ্যুতের আসা-যাওয়াতে যতটা ভোগান্তি হয় রাতে তা কয়েকগুণ বাড়ে। রোববার রাতেও ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে বাইরে যেতে হয়েছে। এছাড়া সেহরি খাওয়ার সময়ও বিদ্যুৎ ছিলো না। তিনি আরও বলেন, লোডশেডিংয়ে শিশুরা বেশি সমস্যায় আছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে তারা ঘুম থেকে উঠে গরমে কান্নাকাটি করে।

শহরের মুদি ব্যবসায়ী মো. কালাম বলেন, দিনেরাতে যে কতবার বিদ্যুৎ গেছে তার কোনো হিসাব নেই। রাতে বিদ্যুৎ না থাকলে ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থেকে সারাদিন কি কাজ করা যায়?

ফয়েজ আলী বলেন, বারবার বিদ্যুৎ অফিসে কল দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। গ্রাহকদের সমস্যা যেনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো বিষয়ই না। নিজেদের মতো করে বিদ্যুৎ দেয়া-নেয়া করায় তাদের কাজ। অফিসে কল দিলেও কোনো কাজ হয় না। তিনি আরও বলেন, কিছুক্ষণ পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। এতে ঘরের টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটারের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে ইলেকট্রনিক্স জিনিস অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পৌর এলাকার কৃষক মাহাফুজ বলেন, রোদের কারণে ধানের জমিতে পানি রাখতে হচ্ছে। এজন্য সেচযন্ত্রের মাধ্যমে জমিতে পানি দিতে হয়। কিন্তু বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

অপরদিকে, চুয়াডাঙ্গায় তীব্র গরমে শিশুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সদর হাসপাতালটিতে শয্যার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি শিশুরোগী ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃর্তপক্ষ। সোমবার এ চিত্র দেখা যায়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৫০ জন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৫২ জন, জ্বরসহ গরমজনিত অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পুরুষ ও নারী মেডিসিন ওয়ার্ডে ২৪০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া বহিঃবিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন চার শতাধিক রোগী। সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গত তিন দিন আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত দুই বছর বয়সি মেয়েকে ভর্তি করেছেন সাবিনা খাতুন। তিনি বলেন, আমার মেয়ের হঠাৎ নিউমোনিয়া হয়েছে। গত তিনদিন থেকে ভর্তি রয়েছে। ডাক্তার বলছেন, আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। এখানে অনেক রোগীর চাপ। ওয়ার্ডে কোনো জায়গা নেই। তাই মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় রয়েছি। সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান মিলন বলেন, তীব্র গরমে হাসপাতালে শিশুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শয্যার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। তাই চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই গরমের সময় শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বুকের দুধসহ তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :