April 25, 2024, 1:27 pm

কবির পরিচয়ে কি তাঁর পরিচয়?

সংগ্রাম মিত্র: কলকাতা ভারত।।

আমি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছি।
১৯০৫ জন্মের দ্বি -শতবর্ষ পেরিয়ে এসেছি।
আজ আরও সাতটি বছর অতিবাহিত তাঁর দ্বিশততম ১৫ মে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে তাঁর জন্ম।
আমরা কি কবির পরিচয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনেছি ! না বোলপুর ভুবনডাঙার মাঠে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ,যা আজ বিশ্বভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়।
শুধু তাই নয় আরও তাঁর কৃতিত্ব বিশ্ব জোড়া
অথচ অসামান্য বাঙালির জন্মের দ্বি -শতবর্ষ উদযাপনেও সেভাবে কেউ উদ্যোগী হননি ৷ না কলকাতায় , না শান্তিনিকেতনে ৷ এই বিস্মৃতি তাঁর প্রাপ্য ছিল না৷ যে দুই একটি উদ্যোগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল , সেখানে রবীন্দ্রনাথের পিতা -রূপেই তিনি আলোচিত হয়েছেন বেশি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বঙ্গমনীষী রূপে তাঁর মূল্যায়ন -প্রয়াস এখনও লক্ষ্য করা গেল না ৷ গোটা ২০১৭ জুড়ে আচার্য দেবেন্দ্রনাথকে ভুলে থাকলে বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়কেই বাঙালি ভুলে থাকবে , সে বড়ো সুখের নয় ৷
এই প্রেক্ষাপটেই দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে দু’টি দরকারি বইয়ের পুনর্মুদ্রণ ঘটেছে৷ একটি শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও ভাবুক অজিতকুমার চক্রবর্তী -প্রণীত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনবৃত্তান্ত , অন্যটি প্রিয়নাথ শাস্ত্রী -সম্পাদিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রবালী৷
প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়েছিল মহর্ষির জন্মের শতবর্ষের প্রাক্কালে ১৯১৬ সালে আর দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয় এর বছর সাতেক আগে ১৯০৯ সালে ৷ অর্থাৎ মহর্ষির মৃত্যুর বছর চারেক পরে৷
পত্রাবলী সংকলনকালে সম্পাদক প্রিয়নাথ শাস্ত্রী মশাই একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন ৷ তিনি বইয়ের শুরুতে লেখা ভূমিকায় লিখেছিলেন : ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী মুদ্রিত হইল ৷ ইহাকে তাঁহার স্বরচিত জীবনচরিতেরই আর এক পৃষ্ঠা বলা যাইতে পারে ৷ ’ অজিতকুমার পরে জানিয়ে ছিলেন রাজনারায়ণ বসুকে লেখা দেবেন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা ছিল নাকি প্রায় ছ’শো ! তার মধ্যে মাত্রই শ’খানেক চিঠি প্রিয়নাথ শাস্ত্রী সংকলিত করেন ওই পত্রাবলীতে ৷ এ ছাড়াও অন্যান্যদের উদ্দেশে দেবেন্দ্রনাথের লেখা আর দেবেন্দ্রনাথের প্রতি অন্যান্যদের লেখা আরও গোটা পঞ্চাশেক চিঠি সংকলিত হয়েছিল এই বইতে ৷ এই পত্রাবলী পুনঃপ্রকাশ করেছে কলকাতার এক প্রকাশক ৷ এই উদ্যোগ গ্রহণ করায় প্রকাশিকা ধন্যবাদার্থ কিন্তু এই ধরনের একটি বইতে পাঠ সম্পাদনা ও টীকা আরও প্রযত্ন হলে ভালো হত ৷ তবুও গ্রন্থটি পুনরুদ্ধার করে তিনি উত্তরকালের কাছে একটি দরকারি কাজ করলেন সেটিই কম কি ৷ অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশন সংস্থা প্রকাশ করেছেন অজিতকুমার চক্রবর্তী প্রণীত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী ৷ সম্পাদনা করেছেন রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর মতো প্রবীণ গবেষক ৷ ফলে সেখানে যত্নের চিহ্ন স্বভাবতই অনেকটাই বেশি ৷ এই দুই বই থেকে কোন দেবেন্দ্রনাথ উন্মোচিত হয়ে ওঠেন তার সন্ধান করতে বসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি প্রতিকৃতির কথা মনে এল ৷ চারটি পোর্ট্রেট চারজন শিল্পীর আঁকা ৷ এই চারজনের মধ্যে তিনজন বিদেশি , একজন দেশিয় ৷ প্রথম ছবিটি আঁকেন উইলিয়ম বিচি , দেবেন্দ্রনাথের তখন কিশোর বয়স ৷ পোশাকে বৈভবের চিত্রটি সম্পূর্ণ ৷

দ্বিতীয়টির চিত্রকর মার্শাল ক্ল্যাক্সটন ৷ এখানেও লক্ষ্য করা যাবে পোশাকে আর সজ্জায় এক অমিতশালী ঐশ্বর্য ও বৈভবের প্রতিচিত্রণ ৷ তৃতীয় ছবির শিল্পী উইলিয়ম আর্চার , এই ছবিটিতে প্রৌঢ় সন্ন্যাসীপ্রতিম ব্যক্তিত্বের প্রশান্ত ছবি আর চার নম্বরটি অবন ঠাকুরের আঁকা ৷ ছবিটিতে বৃদ্ধ দেবেন্দ্রনাথের শান্ত মুখচ্ছবিতে এক প্রাচীন ধীর -স্থির নীরবতার মুহূর্ত যেন স্থির হয়ে রয়েছে৷ চারটি ছবি চারটি ভিন্ন সময়ে আঁক ৷ চারটি ছবিই বেশ পশ্চিমি বাস্তবধর্মী ছবির শর্ত মেনে আঁক ৷ তৃতীয় আর চতুর্থ ছবিতে যে -দেবেন্দ্রনাথকে আমরা দেখি , সেই দেবেন্দ্রনাথই বেশি পরিচিত ৷ তিনি ব্রাহ্মসমাজের গুরুস্থানীয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , তিনি মহর্ষিদেব ৷ বিষয় হল, রবীন্দ্রনাথের পিতা হিসেবেও যখন আমরা কল্পনা করি , তখনও সেই মহর্ষিদেবের ছবিই আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে ৷ কিন্তু , অন্য এক দেবেন্দ্রনাথও তো ছিলেন ৷ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র সেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিই যেন ধরা পড়ে তাঁর প্রথম দিকের ছবিতে ৷ এক বিস্তারিত তাৎপর্যে এই পর্বান্তরের কাহিনিই যেন দেবেন্দ্রনাথের জীবন -বৃত্তান্ত ৷

দেবেন্দ্রনাথের বাল্যজীবনের কাহিনি তাঁর জীবনীতে বা আত্মজীবনীতেও বিশেষ নেই ৷ কারণ , তাঁর আত্মজীবনী শুরু হয়েছিল তাঁর আঠারো বছর বয়সের ঘটনা থেকে ৷ তবে সেই আত্মকথার শুরুতেই রয়েছেন দু’টি মানুষ ৷ এক দিকে তাঁর পিতামহী অলকাসুন্দরী দেবী অন্য দিকে রাজা রামমোহন রায় ৷ এই অলকাসুন্দরী ছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা রামলোচন ঠাকুরের স্ত্রী ৷ বস্তুত অলকাসুন্দরী ছিলেন দ্বারকানাথের জেঠিমা , কিন্ত্ত নিঃসন্তান রামলোচন দ্বারকানাথকেই দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন , সম্পর্কে তিনি দেবেন্দ্রনাথের ঠাকুমাই হলেন ৷ অলকাসুন্দরী ছিলেন প্রবল পৌত্তলিক আর ধর্মপরায়ণ কুলবধূ আর অন্য দিকে পৌত্তলিকতার তীব্র বিরোধী রাজা রামমোহন রায় ৷ এই দুই প্রান্তিক ভাবনার মানুষের স্নেহচ্ছায়ায় বড়ো হয়ে উঠলেন দেবেন্দ্রনাথ ৷ আর এর মাঝখানে রয়েছেন পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুর ও তাঁর বিষয়বুদ্ধি ৷ অর্থাৎ এক দিকে অর্থবিত্ত অন্য দিকে ধর্মাচরণ , সেই ধর্মাচরণের আবার এক দিকে পৌত্তলিকতা , অন্য দিকে অপৌত্তলিকতা — বিপরীত বিচিত্র টানের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ৷ দেবেন্দ্রনাথের জীবনে এই প্রতিটি পর্বই নীরবে ছাপ রেখে গিয়েছে সারা জীবন ৷ ধনাঢ্যতার মধ্যে বড়ো হয়ে উঠলেও ১৮৩৮ সালে এই পিতামহীর মৃত্যুই তিনি প্রথম বিচলিত হন ৷ কুড়ি বছর বয়সে পিতামহীর মৃত্যু আর ত্রিশ বছর বয়সে বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু তাঁকে দুই ভাবে জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় ৷ পিতামহীর মৃত্যুর অব্যবহিত আগের দিন নিমতলাঘাট শ্মশানে বসে হঠাৎই কিশোর দেবেন্দ্রনাথের মনে এক আশ্চর্য অনুভূতি হল।
তা পরবর্তী লেখায় তুলে ধরবো। আজ এই পর্যন্তই প্রণাম ঠাকুর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :