অনলাইন ডেস্ক।।
কাউন্সিল ছাড়াই বিএনপিতে যে ‘পুনর্গঠন’ প্রক্রিয়া চলছে তার জেরে বিভিন্ন পদে রদবদল হচ্ছে। এর ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে অস্থিরতা। দলের ভেতরেই অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ‘প্রমোশন-ডিমোশন’ (পদোন্নতি-পদাবনতি) প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্যরা চেয়ার দখল করছেন, আর পরীক্ষিত-ত্যাগীরা বাদ পড়ছেন। প্রমোশনের সম্ভাবনায় যাদের সিন্ডিকেট এগিয়ে আছে তাদের মধ্যে যেমন উচ্ছ্বাস, তেমনি ডিমোশন পাওয়া নেতারা ছাড়ছেন দীর্ঘশ্বাস। অবশ্য একে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখছেন দলের দায়িত্বশীল নেতারা। পাশাপাশি ‘সময়ের অপেক্ষা’ করতে বলছেন কেউ কেউ।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলটির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকটি পদ পূরণ হয়নি। সে পদগুলোর কোনো কোনোটি এখনো ফাঁকা। আবার কিছু পদের নেতার প্রমোশন-ডিমোশনও হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ১৯ জুন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমানকে প্রমোশন দিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
দলটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি সম্প্রতি সরব হয়েছেন। দলে প্রমোশনের সিগন্যাল পেয়েই তিনি সক্রিয় হয়েছেন বলে দলের অভ্যন্তরে গুঞ্জন রয়েছে। খুব শিগগির স্থায়ী কমিটিতে তাকে প্রমোশন দেওয়া হতে পারে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার আশায় আরও রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, মোহাম্মদ শাহজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল।
এছাড়া বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন যুগ্ম-মহাসচিব পদে, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিপুন রায় ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু যুগ্ম-মহাসচিব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল এবং যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম সহ-দপ্তর সম্পাদক পদে পদোন্নতি পেতে পারেন।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা রেজাউল করিমের নামও প্রমোশনের তালিকায় আছে বলে শোনা যাচ্ছে। পদোন্নতির তালিকায় থাকতে পারে চাঁদপুর জেলা বিএনপি নেতা শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, ঢাকা জেলার নেতা খন্দকার আবু আশফাক, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসান মিন্টু, কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, সাবেক মৎস্যজীবী দল নেতা আরিফুর রহমান তুষার, আড়াইহাজার বিএনপির নেতা মাহবুবুর রহমান সুমনের নামও।
এদিকে বিএনপিতে ‘এক নেতা এক পদ’ নীতি চালু হলেও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম এবং আমানউল্লাহ আমানকে যথাক্রমে ঢাকা মহানগর বিএনপির দক্ষিণ ও উত্তর শাখার আহ্বায়ক করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলামকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব করা হয়েছে। সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামকে স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ওবায়দুর রহমান চন্দনকে রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আব্দুল খালেককে রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নিযুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলকে কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তাক মিয়াকে বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইসলাম অমিতকে ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। কুমিল্লা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মো. সায়েদুল হক সাঈদকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির পদ থেকে ইস্তফা দেন সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান। ২০২০ সালের শেষ দিকে সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) এম আনোয়ারুল আজিমকে কেন্দ্রীয় বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে জেলা সভাপতি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পদ থেকেও।
গত ২৫ ডিসেম্বর বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যুগ্ম-মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ারকে বরিশালের স্থানীয় নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সম্পাদক বলেন, হঠাৎ করেই দলে ও সমাজে গ্রহণযোগ্য নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার কারণে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাউন্সিল ছাড়া এভাবে পদায়ন-অব্যাহতির ফলে অনেক ক্ষেত্রে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র এবং কম পরীক্ষিত নেতারা দায়িত্বশীল হওয়ায় সিনিয়ররা সেখানে উপেক্ষিত হচ্ছেন। এতে তৃণমূল পর্যন্ত দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির শঙ্কা প্রবল হচ্ছে। ফলে চেইন অব কমান্ড থাকে না। যেটা দলের জন্য খুবই জরুরি।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, নেতাদের দল থেকে অব্যাহতি-পদোন্নতি নিয়ে নাটকীয় কাণ্ড চলছে বিএনপিতে। লন্ডন থেকে (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের তরফ থেকে) আসা বার্তার ফলে এমন পরিবর্তন ঘটছে, এতে চিন্তায় আছেন অনেকে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় রদবদল নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সংগঠনে পার্টি প্রধানকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। তিনি কিছু পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন করতে পারেন। এত বড় পার্টির ক্ষেত্রে সেটির একটা প্রতিক্রিয়া থাকতেই পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে চলমান একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে বিএনপির নতুন নতুন নেতৃত্ব সংযুক্ত করা, ভালো বা খারাপ ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হবে।
তিনি আরও বলেন, কিছু মানুষ আছে যারা পরীক্ষিত। অতীতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা যদি বাদ পড়েন তাহলে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হতে পারে। তাদের পরিবর্তে যারা আসেন তারা আবার সফল না ব্যর্থ সেটা দেখতেও অপেক্ষা করতে হবে। সেজন্য আমার মনে হয় ভালোমন্দ রাজপথে প্রমাণ হবে। যদি আমরা ভালো করি তাহলেই পরিবর্তন ভালো। আবার কোনো কারণে যদি আমরা এই পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে বুঝতে হবে পরিবর্তনটি কাজে আসেনি।
পদোন্নতি পেয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, এত বড় রাজনৈতিক দলে নতুন কমিটি হলে, ভালো প্রতিক্রিয়াও হয় আবার খারাপ প্রতিক্রিয়াও হয়। এটা স্বাভাবিক।
Leave a Reply