April 19, 2024, 9:39 pm

ইসলাম ধর্মে মৃত মা-বাবার হক

অনলাইন ডেস্ক।।
এই দুনিয়ার জমিন ছেড়ে সবাইকে একদিন যেতে হবে, আর এটাই চিরন্তন সত্য, যা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমের সুরা আল-ইমরানে ১৮৫ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন- ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’। সুতরাং আমাদের মা-বাবাসহ সবাই একদিন না একদিন মরতেই হবে। আর এই মরনের পর মানুষ অন্ধকার কবরে গিয়ে কোন নেক কাজ করতে পারে না। তবে যারা জীবিত থাকেন তারা যদি কোন ভাল কাজ করেন মৃত ব্যক্তিদের জন্য তখন তাদেরকে এর সাওয়াব দেওয়া হয়, যাহা কুরআন শরীফ ও হাদিস শরীফের বহু দলিল দ্বারা প্রমাণিত। বিশেষ করে আমাদের যাদের মা-বাবা এই দুনিয়ার জমিন ছেড়ে চলে গেছেন তাদের অনেক হক আমাদের উপরে থেকে যায়, যেমনি ভাবে তারা জীবিত থাকা অবস্থায় ছিল। ইনশা আল্লাহ, আজকে আমরা সংক্ষিপত আকারে জানব ‘মৃত মা-বাবার হক সম্পর্কে’।
গোসল ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা : ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন দেওয়া ফরজে কেফায়া। এবং যাতুল আখিরাত কিতাবের মধ্যে এসেছে মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন দেওয়া যেভাবে ফরজে কেফায়া তেমনি ভাবে দাফন করার জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাওয়াও তদ্রূপ ফরজে কেফায়া। সুতরাং এর থেকে আমরা অবশ্যই বুঝতে পারছি, মৃত ব্যক্তি যদি নিজের মা-বাবা হন তাহলেত এই দায়িত্ব পালন করা কত গুরুত্বপূর্ণ সন্তান হিসেবে। আর মৃত ব্যক্তিকে গোসল ও কাফন-দাফন করার কাজে যারা থাকবেন, তাদের ফযীলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে এসেছে- ‘হযরত আবু রাফে (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কোন মুসলিম মাইয়েতকে গোসল করাবে, অতঃপর তার গোপনীয়তা সমূহ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাকে চল্লিশ বার ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতকে কাফন পরাবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের মিহি ও মোটা রেশমের পোষাক পরিধান করাবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতের জন্য কবর খনন করবে, অতঃপর দাফন শেষে তা ঢেকে দিবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত পুরস্কার দিবেন জান্নাতের একটি বাড়ীর সমপরিমাণ, যেখানে আল্লাহ তাকে রাখবেন।’ (হাকেম, ছহীহ তারগীব ও আহকামুল জানায়েয)
সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যাক্তি মৃতকে গোসল দিল, কাফন পরালো, সুগন্ধি মাখালো, বহন করে নিয়ে গেল, তার জানাজার নামাজ পড়লো এবং তার গোচরীভূত হওয়া তার গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করল না, তার থেকে গুনাহসমূহ তার জন্মদিনের মত বের হয়ে যায়’।
তাদের ওসিয়ত পূরন করা : সহীহ ইবনে হিব্বানে এসেছে- ‘হযরত রাশিদ ইবনে সুয়াইদ আশ-শাকাফী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার মা একজন দাস মুক্ত করার ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার কাছে কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তাকে নিয়ে এসো। সে আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে? সে উত্তর দিল আল্লাহ তায়ালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, আমি কে? সে উত্তর দিল আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও। কেননা সে মুমিনা’।
তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা : আদাবুল মুফরাদে এসেছে- ‘হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মানুষের মৃত্যুর পর তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে, হে প্রভু! এটা কি জিনিস? তাকে বলা হয়, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে’। মুসনাদুল বাজ্জারে এসেছে- ‘হযরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পাশে দাড়ালেন। আতপর বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। এবং তার ঈমানের উপর অবিচল ও দৃঢ়তা কামনা কর। কেননা এখন তাকে প্রশ্ন করা হবে’।
তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা : মা-বাবাসহ সমস্ত মুমিন মুসলমানদের জন্য কিভাবে দোয়া করতে হবে, সেই সমস্ত দোয়া আল্লাহ তায়ালা নিজেই কুরআনু কারীমে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যেমন- সূরা বনী ইসরাঈলের ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন- ‘হে আমার প্রভু! আমার মা-বাবার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা আমাকে ছোট থাকতে দয়া দিয়ে লালন পালন করেছেন’। সূরা ইব্রাহীমের ৪১ নম্বর আয়াতে আবার বলে দিয়েছেন- ‘হে আমাদের প্রভু! যেদিন হিসাব হবে সেদিন আমাকে, আমার মা-বাবাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করো’।
সূরা নুহ এর ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আবার শিখিয়ে দিলেন- ‘হে আমার প্রভু! আমাকে, আমার মা-বাবাকে, আমার ঘরে ঈমানের সাথে যে প্রবেশ করে তাকে এবং সব ঈমানদার পুরুষ ও নারীকে ক্ষমা করো, আর জালেমদের শুধু ধ্বংসই বাড়িয়ে দাও’।
সুতারাং প্রত্যেক মা-বাবার উচিত এমন সন্তান রেখে যাওয়া যারা দোয়া করবে। কেননা সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমাল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার আমাল ছাড়া। ১. সদাকাহ্ জারিয়াহ। ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দোয়া করতে থাকে”।
তাদের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা : সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে এসেছে- হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- মুমিন ব্যক্তির রূহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়”।
ইবনে মাজাহ শরীফে আরো এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোন ব্যক্তি তার যিম্মায় এক দীনার বা এক দিরহাম পরিমাণ ঋণ রেখে মারা গেলে কিয়ামতের দিন তার নেক আমলের দ্বারা তা পরিশোধ করা হবে। আর সেখানে কোন দীনারও থাকবে না দিরহামও থাকবে না”।
সুনানে আন-নাসায়ীতে এসেছে- হযরত মুহাম্মাদ ইবনে জাহাশ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় তিনি আকাশের দিকে তাঁর মাথা উঠান, তারপর তাঁর হাত ললাটের উপর স্থাপন করে বলেন, সুব্হানাল্লাহ্! কী কঠোরতা অবতীর্ণ হলো! আমরা ভয়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। পরদিন আমি জিজ্ঞাস করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ! ঐ কঠোরতা কী ছিল, যা অবতীর্ণ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ তাঁর কসম। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, আবার জীবন লাভ করে, আবার শহীদ হয় এবং আবার জীবিত হয়, পরে আবার শহীদ হয়, আর তার উপর কর্জ থাকে, তবে তার পক্ষ হতে সে কর্জ আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না”।
তাদের পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করা : সূরা নিসার ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “একজন ঈমানদার আরেকজন ঈমানদারকে হত্যা করতে পারে না (কোন ঈমানদারকে হত্যা করলে হত্যাকারী আর ঈমানদার থাকে না), তবে ভুলক্রমে হত্যা করলে ভিন্ন কথা। কেউ যদি কোন ঈমানদার লোককে ভুলক্রমে হত্যা করে তাহলে তাকে একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে এবং নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে, তবে তারা মাফ করে দিলে ভিন্ন কথা। যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের কোন শত্রুপক্ষের লোক হয় এবং ঈমানদার হয় তাহলে একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে। আর যদি এমন কোন গোষ্ঠীর লোক হয় যাদের সাথে তোমাদের শান্তিচুক্তি আছে তাহলে তার পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হবে এবং একজন ঈমানদার দাস মুক্ত করতে হবে। যে তা পারবে না তাকে আল্লাহর কাছ থেকে পাপমুক্তি কামনায় অবিরাম দুই মাস রোযা রাখতে হবে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়”। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে গভীর রাত পর্যন্ত বিলম্ব করে। এরপর তার গৃহে গিয়ে দেখে যে, বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার স্ত্রী তার খাবার নিয়ে এলে সে সন্তানদের কারণে কসম করলো যে, সে খাবে না। পরে খাবার গ্রহণকে উচিত মনে করলে সে খেয়ে নিল। এরপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে তাঁকে উক্ত ঘটনা বলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খায়, পরে অন্যটিকে তা থেকে উত্তম মনে করে, যে যেন তা করে ফেলে এবং নিজের কসমের কাফফারাহ দেয়”।
তাদের পক্ষ থেকে মান্নত পূরন করা: সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ আনসারী (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কোন এক মানতের ব্যাপারে, যা আদায় করার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার মায়ের পক্ষ থেকে মানত পূর্ণ করার আদেশ দিলেন। পরবর্তীতে এটাই সুন্নাত হয়ে গেল।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :