April 25, 2024, 3:15 am

যৌন হয়রানি বন্ধে চাই সামাজিক প্রতিরোধ

অনলাইন ডেস্ক।
বর্তমানে যৌন হয়রানি দেশে একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে সবখানে মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও এমন নির্মম ঘটনার শিকার হওয়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কর্মস্থলে আসা মেয়েদের খবর চোখে পরছে, যা দুঃখজনক।

সাম্প্রতিক সময়ে যৌন হয়রানি মেয়েদের জন্য একপ্রকার অভিশাপে রূপ নিয়েছে। অসভ্য ও বখাটে শ্রেণির যুবক, শিক্ষার্থী ও নরপুরুষেরা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে মেয়েদের ওপর এহেন যৌন হয়রানি করেই চলেছে। যা মেনে নেওয়া কঠিন।

গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক ছাত্রী এমনি যৌন হয়রানির নির্মম ঘটনার শিকার হয়। যদিও উক্ত ঘটনাটি বিশেষভাবে সকলের সামনে আসে গত ২০শে জুলাই রাতে। সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার প্রতিবাদে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলে সে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

মেয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, “ওই সময় পাঁচ-ছয় জন অজ্ঞাতনামা তাদেরকে ধরে হয়রানি করে, মারধর করে এবং মোবাইল ছিনতাই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন এলাকা থেকে। ছিনতাই করার পর তাদের বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনের দিকের রাস্তা যেটি প্রায় অন্ধকার থাকে, সেখানে নিয়ে গিয়ে কাপড় খুলে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে। সেসময় তাকে যৌন হয়রানিও করা হয় বলে জানায় ওই ছাত্রী।

এরপর তাকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয় যে, সে যদি এই ঘটনা অন্য কোথাও বলে তাহলে সেই ভিডিও প্রকাশ করে দেয়া হবে। যা সত্যি বেদনাদায়ক। যদিও এমন অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই হচ্ছে কিন্তু অনেককে ভয়ে, শরমে তা প্রকাশ করছে না।

যদিও ইতিমধ্যে র্যাবের বিশেষ অভিযানে অপরাধি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নামক ৬জন নরপশুর মধ্যে ৪জনকে ধরা সম্ভব হয়েছে। যা ইতিবাচক বলে মনে করি। এখন ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বাকিদের অতিদ্রুত ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে এমনটি সকলের প্রত্যাশা।

যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে হাজারও নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। সমাজে যৌন হয়রানি ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। আধুনিক সভ্যতা, সামাজিক মূল্যবােধ, ন্যায়-নীতি, নারীর প্রতি সম্মানবােধ ও মনুষ্যত্ববােধকে বিসর্জন দিয়ে সমাজে একদল অসভ্য শ্রেণির পুরুষ এহেন কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে।

এদের অসভ্য আচরণের শিকার হয়ে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করছে আবার অনেকে প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে অস্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করেছে, আবার কেহ এইসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপরাধকারীদের হাতে খুন হচ্ছে আবার কেউবা ইভটিজিংকারীকে খুন করে খুনি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই যৌন হয়রানি প্রতিরােধ করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সমাজে কিছু অসভ্য শ্রেণির মানুষ থাকে, যারা নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে না এমনকি অন্যের সম্মানের ওপর আঘাত করতেও দ্বিধা করে না। আর এইসব আত্ম-সম্মানহীন ছেলেদের হাতে মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হয়, যা দুঃখজনক।

এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মেয়েরা যেমন লাঞ্ছনায় পড়ে তেমনি তার আত্মীয়-স্বজনদের ওপর বখাটেরা হামলা চালায়। এতে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি, মারাত্মক জখম, খুন, ভাঙচুর, থানা-পুলিশের মতাে ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া বখাটেরা মেয়েদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযােগ, লুটপাট এবং এসিড নিক্ষেপের মতাে জঘন্য অপরাধ করে থাকে। এতে পরিবার এবং সমাজজীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

প্রযুক্তির অপব্যবহারে যৌন হয়রানির মাত্রা এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এর পরিনতি হবে ভয়াবহ। মােবাইলে মেয়েদের নম্বরে বারবার কল বা মিসড কল দেওয়া, অশ্লীল ছবি, গান, ভিডিও প্রদর্শন করা, ইন্টারনেটে নানা অশ্লীল ছবি প্রকাশ করা, সিডি ও ভিডিওতে পর্নো ছবি ধারণ করে এসব ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে মেয়েদেরকে ব্ল্যাকমেইল করা এবং কম্পিউটারে, মােবাইলে, গানের সাথে নগ্ন ছবি জুড়ে দিয়ে মেয়ে ও তার পরিবারকে হেয় করা বর্তমান প্রযুক্তির নিন্দনীয় দিক। তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা অধিক জরুরী।

বর্তমানে বাংলাদেশে যুবসমাজে যৌন হয়রানির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তারা সব বয়সেই এমন নির্লজ্জ কাজ করে থাকে। বিভিন্ন কারণে যৌন হয়রানির মতাে অশ্লীল কাজ ঘটে থাকে। যেমন— নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা, নারীকে মূল্যায়ন করা, বেকারত্ব, অশিক্ষা ও অর্ধশিক্ষা, পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষার অভাব, পারিবারিক ও রাজনীতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিস্তার, কঠোর আইন ও তার সুষ্ঠু প্রয়ােগের অভাব, মেয়েদের ভােগ্য পণ্য মনে করা, কিছু নারীর অশালীন পােশাক পরিধান করা, সামাজিক সচেতনতার অভাব ও মূল্যবােধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতির বিস্তার, পর্নো ছবির প্রচার, মাদকে অবাধ আসক্ত হওয়া, মেয়েদের অল্পতে ভীতু হওয়া ও প্রতিবাদ না করার অভ্যাস প্রভৃতি সমাজে যৌন হয়রানির মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে উল্লেখিত বিষয়সমূহের দ্রুত প্রতিকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহন জরুরী বলে মনে করি।

বর্তমানে এই ক্যানসারের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের অসংখ্য নারী । আর এই ঘটনা বেশিরভাগ ঘটে থাকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজ নিজ কর্মস্থলে। যৌন হয়রানির ফলে নারীরা যেমন বিপর্যস্ত হয় তেমনি অনেকে আত্মহত্যা করে, অনেকে অকালে পড়ালেখা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে, আবার বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়, অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়, বখাটেদের বাধা দিতে গিয়ে অনেকে জীবন হারায়। ফলে দেশ ও সমাজ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে । লএ ব্যাধি দেশ ও নারী সমাজের অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় কারণ। তাই আমাদের দেশকে সামাজিক ব্যাধি মুক্ত করতে হবে।

যৌন হয়রানি প্রতিরােধে আমরা নিমােক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি : ১) যৌন হয়রানি প্রতিরােধ করতে নারী, পরিবার ও জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। এতে সমাজ থেকে যৌন হয়রানি নিমূল করা সম্ভব হতে পারে। ২) এই ধরনের অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়ােজন এবং তা বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলে বখাটেরা ভয় পেয়ে যৌন হয়রানি করা থেকে বিরত থাকবে। ৩) নারীদের উত্ত্যক্তকারী বখাটেদের চিহ্নিত করে খুব দ্রুত আইনের আশ্রয় নিতে হবে। পুলিশের হাতে বখাটেদের ধরিয়ে দিতে হবে এবং আইনি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সহকারে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। এতে একজনের শাস্তি দেখে যেন অন্যেরা যৌন হয়রানির এহেন কুকর্ম থেকে বিরত থাকবে। ৪) যৌন হয়রানি রােধ করতে হলে মেয়েদের সচেতন হতে হবে এবং একে অপরকে সহযােগিতা করতে হবে। মেয়েরা যদি নিজেদের সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলে তাহলে বখাটে ছেলেরা ভয় পাবে এবং যৌন হয়রানি থেকে বিরত থাকবে। মেয়েদের সাহসিকতা যৌন হয়রানি প্রতিরােধে অধলিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এবং ৫) যৌন হয়রানি বন্ধে বাংলাদেশ সরকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে বখাটেদের বিচারের মুখােমুখি করা। দোষীদের জেল, জরিমানা ও কারাদণ্ড প্রদান করা। তাছাড়া মেয়েদের নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরে পক্ষ থেকে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করা অধিক জরুরী বলে মনে করি।

পরিশেষে বলতে চাই যেহেতু বাংলাদেশে যৌন হয়রানি অন্যতম সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত এর প্রতিকার করা জরুরি। কেননা আমাদের দেশের ছাত্রী এবং নারী সমাজকে যৌন হয়রানি নামক নির্মম অভিশাপ থেকে দ্রুত মুক্তি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর নারী সমাজকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে হলে সমাজ থেকে এইসব ভন্ড, লম্পট ও মাতাল বখাটে এবং ভালোর মুখোশধার ভন্ডদের নির্মূল করতে হবে এবং বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে । পাশাপাশি বখাটেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজটি বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক- কলামিষ্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :