April 24, 2024, 2:10 pm

শনিবার পর্যন্ত তীব্র শীত অব্যাহতের শঙ্কা

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তীব্র শীতের অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাছাড়া পরবর্তী ২ দিনেও আবহাওয়ার ‘উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই’ বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।

আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদের দেয়া বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ‘উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।’

কুয়াশা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।’ আর তাপমাত্রা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা পার্থক্য হ্রাসের কারণে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে।

প্রসঙ্গত গতকাল বুধবার (৪ জানুয়ারি) ঘন কুয়াশার কারণে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি। এদিন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারাদেশে সর্বত্র সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে।

এদিকে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে বাড়ছে শীতের তীব্রতা, জেঁকে বসেছে শীত। বিকেল থেকে বাড়তে থাকে হিমেল হাওয়া ও কুয়াশা পড়া। ভোর থেকে বেলা ১১ টা বাজেও দেখা মিলে না সূর্যের। রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির মতো ঝড়ছে কুয়াশা। এমন কনকনে ঠান্ডায় চরম বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া তেঁতুলিয়ার মানুষ।

মধ্যরাত থেকে দিন ১১ টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে চারদিক। ফলে এসময় হেড লাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হয়। শীতের কারণে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের। হাসপাতাল গুলোতে বেড়েছে শীতজনিত রোগীর আধিক্য। জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া সমস্যা নিয়ে রোগীরা হাসপাতাল গুলোতে ভর্তি হচ্ছেন। আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু। চিকিৎসকরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে। এমনিতে শীত মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই এ সময়টাতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে কিছুটা হলেও সুরক্ষা পাওয়া যাবে।

এই হাড়কাঁপানো শীতে কাজে যেতে পারছেন না অনেকেই। তবে পেটের তাগিদে কাউকে নদীতে পাথর তুলতে, কাউকে চা-বাগানে আবার কাউকে দিনমজুরের কাজ করতে যেতে দেখা গেছ। এদিকে তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান, বুধবার সকাল ৯ টায় সর্বনিম্ন ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

রংপুরে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে জেঁকে বসেছে শীত। তাপমাত্রা ওঠানামা করার সঙ্গে বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। শিশুদের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছেন বয়স্করাও।

শীত নিবারণে আগুন পোহাতে গিয়ে ঘটছে অগ্নিদগ্ধের ঘটনাও। এতে করে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। গত এক সপ্তাহে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ও বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছে তিন শতাধিকের বেশি রোগী। ভর্তি হওয়া এসব রোগীর মধ্যে সাতদিনে ১৫ শিশু ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। যাদের সবার বয়স ১ মাস থেকে চার বছরের মধ্যে। এছাড়া শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ দুই নারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

রংপুর সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। দিন দিন তাপমাত্রা কমে আসাতে শীতে শিশু ও বয়স্করা কাবু হচ্ছেন। তবে চলতি সপ্তাহের চেয়ে গত সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।

বুধবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে রমেক হাসপাতালের তৃতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে অনেক শিশুকে মেঝেতে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে। প্রতি শয্যায় মায়েরা সন্তান নিয়ে বসে আছেন। কোনো শয্যায় দুইজন, কোথাও তিনজন। অনেকে সন্তানের চিকিৎসা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওয়ার্ডের বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন। শিশুর সঙ্গে অভিভাবকদের এমন ভিড়ের কারণে নার্স ও চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মোছা. শিখিলী খাতুন জানান, এবার কোল্ড ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০টি শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে।

আড়াই মাস বয়সী শিশু আহনাফ বাবুকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন মা আলোবানু। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থেকে আসা এই নারী জানান, তার ছেলের কয়েকদিন ধরে সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। শীতের কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন।

হাসপাতালের শিশু বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহে ১৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রংপুরের মিঠাপুকুরের ১০ মাসের শিশু ওমর আলী, লালমনিরহাট পাটগ্রামের ৩ বছরের শিশু, গাইবান্ধার নবজাতক, কুড়িগ্রাম চিলমারির আড়াই বছরের শিশু, রংপুর নগরীর শালবন এলাকার ১৯ মাসের মাহমুদুল হাসান রয়েছে।

হাসপাতালে সেবা প্রদানে ব্যস্ত নার্স ও চিকিৎসকদের দাবি, শুধু শীতজনিত রোগে এসব শিশুর মৃত্যু হয়নি। শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, অপরিপক্ক ও কম ওজনের নবজাতক এবং জন্মের সময় মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণত শীতকালে শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বেশিরভাগই গ্রাম থেকে আসা।

শুধুমাত্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এমন চিত্র নয়, উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও গাদাগাদি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গুরুতর অসুস্থ শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছে।

শিশু বিভাগ সূত্র জানায়, দুইটি শিশু ওয়ার্ডে গত দুই সপ্তাহ ধরে শিশু রোগী ভর্তির সংখ্যা শয্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যাদের বয়স একদিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত। শীতের আগে এই ওয়ার্ডে এভাবে এত রোগী থাকতে দেখা যায়নি বলে চিকিৎসক ও নার্সরা জানান। শীত যতই বাড়ছে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে।

শিশু ওয়ার্ডে দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফনার্স মোঃ মানিক বলেন, শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নবজাতকদের শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও হাঁপানি দেখা দেয়। এ সময়ে শীতজনিত রোগ ছাড়াও নবজাতকের ক্ষেত্রে অপরিপক্ব ও কম ওজনের শিশুও ভর্তি হয়। তাদের উষ্ণতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী তারা উষ্ণতা পায় না। এজন্য মায়েদের এই সময়টা বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়া দরকার।

হাসপাতালের শিশু বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. তানভীর চৌধুরী জানান, গত সপ্তাহের চেয়ে চলতি সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা কম। আগের সপ্তাহে ৪ শতাধিক রোগী সেখানে চিকিৎসা নিয়েছে।

রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শামীম আহমেদ বলেন, শীতের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। তবে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

অন্যদিকে শীত নিবারণে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে রমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আফরোজা (৩৭) ও পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নছিমন বেওয়া (৬৮) নামের দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধ ৩৩ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কারো কারো শরীরের ৮০ শতাংশ, আবার কারো শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি।

হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে ৩৪ জন ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে চারজনকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করা হয়েছে। এছাড়া গত মাসে বহির্বিভাগে ৪১ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সরকারি কোনো অনুদান না পাওয়ায় চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরও সংবাদ :